পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) তাৎপর্য

ড. আ.ম.কাজী মুহাম্মদ হারুন উর রশীদ | বৃহস্পতিবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ

আজ ১২ রবিউল আউয়াল বৃহস্পতিবার পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। মহান আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাতের স্মৃতিময় দিন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের একই দিনে ইহকাল ত্যাগ করেন। আজ ১২ রবিউল আউয়াল মুসলিম বিশ্বে এক আবেগময় আবহ সৃষ্টি করে। কারণ আজকের এই দিনে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের আনন্দ এবং তিরোধানের বেদনা বহন করে আনে। ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মানব ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ এবং স্মরণীয় দিন। নবীকুল শিরোমণি পৃথিবীতে আগমন উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহর জন্য সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দউৎসব। মানবতার মুক্তিদূতের পুণ্যময় স্মৃতিবিজড়িত এ দিবস শুধু মুসলিম নয়; বরং জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত।

রবি’ আরবি শব্দ। অর্থ হচ্ছে বসন্ত, সঞ্জীবনী ও সবুজের সমারোহ। রবিউল আউয়াল অর্থাৎ প্রথম সঞ্জীবনীর মাস। এ নামকরণের তাৎপর্য হচ্ছে, মক্কার কাফির ও কোরাইশরা অনাবৃষ্টি খাদ্যের অভাবের কারণে কঠিন বিপদের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলো। রাসুলেপাক (সা.) যে বছর মা আমিনার কোলে আগমন করলেন, সে বছর মক্কার শুষ্ক জমি সঞ্জীবিত হয়ে উঠলো এবং শুষ্ক বৃক্ষ তরতাজা হলো। আর চতুর্দিকে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতে লাগলো।

আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে পৃথিবীর সব জাতিই কমবেশি জানতেন। প্রত্যেক নবীই তাঁর আগমন সম্পর্র্কে ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন। চৌদ্দশ’ বছর আগে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হন, যখন সমগ্র পৃথিবী অন্ধকারের অতল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। মানব সভ্যতার লেশমাত্রও অবশিষ্ট ছিলো না এবং ন্যায় বিচার বলতে কিছুই ছিলো না; বরং হিংসাবিদ্বেষ, যুদ্ধসংঘাত, অত্যাচারঅনাচার, চুরিডাকাতি, হত্যারাহাজানি, সর্বপ্রকার অন্যায়, অপকর্ম ও পাপাচারে মানুষ লিপ্ত ছিলো। কোথাও ছিলো না শান্তি, ছিলো না কোথাও স্বস্তি। চলছিলো মানুষে মানুষে হানাহানি, কাটাকাটি, দূর্বলরা শক্তিধরদের অত্যাচার ও নির্যাতনে জর্জরিত হচ্ছিলো। ধর্মের নামে সর্বত্র বিরাজ করছিলো শিরক, কুফর আর ধর্মহীনতা। নারী সমাজ পরিণত হয়েছিলো পণ্য সামগ্রীতে। তাদের ব্যবহার করা হতো আসবাবপত্রের মতো। তাদের ছিলো না কোনো অধিকার, ছিলো না কোনো মর্যাদা। মানবিক মূল্যবোধ বলতে কোথাও কিছু ছিলো না। অরাজকতাপূর্ণ এক অস্থির পৃথিবীতে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সোবহি সাদিকের সময় সমস্ত বিশ্বজগত আলোকোজ্জ্বল করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহক, বিশ্ব জাহানের মুক্তির দিশারী, সায়্যিদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লীল আলামিন, খাতামুন নাবীয়্যীন মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রাসুল (সা.)-এর আগমনে ধন্য হয়েছিলো সমগ্র মাখলুকাত, মুখ থুবড়ে পড়েছিলো দীর্ঘকালের যাবতীয় অন্ধকার এবং বিকশিত হয়েছিলো সত্য সুন্দর হেদায়াতের সমুজ্জ্বল রশ্মি। যুগ, কাল ও মহাকালের বিবর্তনশীল পৈঠায় দাঁড়িয়ে যাঁর আগমনের জন্য জগত অপেক্ষার প্রহর গুনছিলো। যাঁর সান্নিধ্য ও সংস্পর্শ লাভের আশায় কুলমাখলুকাত ছিলো উদ্বেল। তিনি আগমন করেছিলেন বিশ্ববাসীর জন্যে আল্লাহ পাকের অনন্ত অসীম রহমতের জীবন্ত প্রতীক হয়ে এবং বহন করে এনেছেন বিশ্ব মানবতার জন্যে চিরশান্তি ও চির নাজাতের পয়গাম। তাঁরই উছিলায় সৃষ্টি হয়েছে মানবদানব, জ্বীনফেরেশতা, আকাশবাতাস, গ্রহনক্ষত্র, গাছপালা, নদনদী, পশুপাখি, পাহাড়পর্বত, জীবজন্তু, আরশকুরসি ও লওহকলম বলতে গেলে সমুদয় সৃষ্টি জগত।

১৪ শ’ বৎসর আগে রাসুলে কারিম (সা.) আজকের এই দিনে আগমন করার কারণে এ দিনটি রাসুলুল্লাহর আশেকানদের মনকে উতালপাতাল করে তোলে এবং অনাবিল আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি হয়। চারিদিকে ধ্বনিত হয় রাসুলুল্লাহর (সা.)-এর সম্মানে সালাত ও সালাম। আর মুসলিম সমাজে আলোড়িত করে তোলে তাঁর জন্ম থেকে ওফাত পর্যন্ত তেষট্টি বছর হায়াতের ওপর আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল, সিরাত মাহফিল, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি। আজকের এই দিনটি রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনের জন্যেই শুধুমাত্র জাতির ইতিহাসে সমুজ্জ্বল নয়; বরং দু’জাহানের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আজকের এইদিনে রেসালাতের গুরু দায়িত্ব সুসম্পন্ন করে পৃথিবীবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে নশ্বর পৃথিবী থেকে অবিনশ্বর জগতে আল্লাহপাকের সান্নিধ্যে ফিরে গিয়েছিলেন। সেদিন আকাশে বাতাসে যেনো স্বজনহারা বেদনার করুণ সুর বাজছিলো। আকাশেবাতাসে নেমে আসাছিলো এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ। প্রিয়নবী (সা.) তাঁর প্রভুর দরবারে চলে গিয়েছেন এবং তার উম্মতের জন্যে রেখে গেছেন মহাগ্রন্থ আলকুরআন, তাঁর সুন্নাত এবং জীবনাদর্শ। যে আদর্শের মাধ্যমে তিনি পৃথিবীবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন একটি সুখী সমৃদ্ধশালী শোষণমুক্ত শান্তিময় সমাজ। যে সমাজে তিনি মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক ভ্রাতৃত্ববোধ। নিশ্চিত করেছিলেন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।

নবী কারিম (সা.) এসেইে ঘোষণা দিলেন ‘বুয়েসতু মুয়াল্লিমান’ আগত অনাগত সকলের জন্যে আমি শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি।-(হাদিস) শিক্ষক হওয়ার জন্য যেসব মৌলিক গুণাবলীর প্রয়োজন তার পরিপূর্ণ বিকাশ নবী কারিম (সা.)-এর মাঝে বিদ্যমান ছিলো। বিশ্বনবী রাসুলে কারিম (সা.)-এর জীবনাদর্শ বর্ণনাতীত। তিনি ছিলেন মহাগ্রন্থ আলকুরআনের ধারক ও বাহক। কুরআনই হচ্ছে নবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ। তাঁর আদর্শ সম্পর্কে কুরআনুল কারিমে স্বয়ং আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন ‘ইন্নাকা লাআলা খুলকিন আজিম।’ অর্থাৎ ওহে আল্লাহর নবী! নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ চারিত্রিক গুণাবলীর উপর অধিষ্ঠিত। কুরআনুল করিমের মধ্যে আল্লাহপাক আরও বলেছেন ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাহ।’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলগণের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ।– (সুরা আহযাব : আয়াত২১)। মহানবী (সা.)-কে শিক্ষকের মহান গুণাবলী দিয়ে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছেন বিধায় আল্লাহ তায়ালা নবীদের আদর্শের রঙে রঙিন হওয়ার জন্যে আহবান জানিয়েছেন।

আমাদের চারপাশের জগতে যে সকল আদর্শ ব্যক্তির সন্ধান পাই তাদের আদর্শবাদীতাকে অস্বীকার করা যায় না। তবে আমাদের দেখতে হবে যে, একটি মানবসত্তার সবগুলো দিক মানবিক গুণাবলীর দ্বারা কতটুকু পরিপূর্ণ। বিভিন্ন আদর্শবান ব্যক্তিদের মাঝে একদিকে আদর্শের ছোঁয়া লাগলেও অন্যদিকে যাবতীয় দিক অতৃপ্ত, অপূর্ণ এবং ব্যর্থ পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আমরা যখন সর্বোত্তম আদশের শ্রেষ্ঠতম প্রতীক নবী করিম (সা.)-এর দিকে তাকাই, তখন দেখি তিনি কেমন মর্যাদাবান এবং কেমন আদর্শবান পুরুষ। তাঁর পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবন চির অম্লান আদর্শের অমৃত ধারা সর্বত্র বিরাজমান। তিনি এক বৃহৎ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েও তাঁর ইন্তেকাল দিবসে স্বীয় ঘরে তেলাভাবে বাতি জ্বলেনি। এ মহান স্মৃতিবিজড়িত মাহে রবিউল আউয়ালকে শুধুমাত্র সভা, সামবেশ, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে এবং বছরের একটি মাস রাসুল (সা.)-এর মিলাদ ও সীরাত বর্ণনা করে আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হবে না; বরং এ মাহে রবিউল আউয়ালকে আমাদের নবীজীর আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণের একটি প্রেরণার উৎসে পরিণত করতে হবে। সারাবিশ্বে অনৈক্যের রজ্জুয় দোদুল্যমান মুসলিম জাতিকে ঐক্যের মজবুত প্লাটফরমে জড়ো করার দীপ্ত শপথ গ্রহণের মাসই হলো এ রবিউল আউয়াল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মহিমাময় জীবনাদর্শ আমাদের ব্যক্তিজীবনে অনুকরণঅনুসরণ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে তার প্রতিফলনের মাধ্যমে এ পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের হক আদায় করতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকুরআন সুন্নাহর আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী’র (দ.) গুরুত্ব
পরবর্তী নিবন্ধসন্দ্বীপে শহীদ হালিম-লিয়াকত স্মৃতি বৃত্তির পুরস্কার বিতরণ