গত ক’দিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়টি। কে হতে যাচ্ছেন এর উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা বেশ কয়েকটি তালিকা দেখতে পেয়েছি, সেখানে বিভিন্ন বিশিষ্টজনের নামও দেখেছি। আবার প্রস্তাবনা আকারেও কিছু কিছু নামের তালিকা পেয়েছিলাম আমরা। আমরা উৎসুক ছিলাম যে হবু উপদেষ্টামণ্ডলীদের মধ্যে কোনো নারী প্রতিনিধিত্ব থাকছে কি–না বা কোন বিশিষ্ট নারী হবেন উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য, সে বিষয়ে। সেই জল্পনা–কল্পানার অবসান ঘটিয়ে গত ৮ মে ২০২৪ ঘোষিত হলো ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীগণের নাম এবং অবাক করা বিষয় হলো এতে আছেন চারজন নারী প্রতিনিধি! যা একটি অভূতপূর্ব ব্যাপার বটে! এই চার নারী উপদেষ্টারা হলেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ফরিদা আখতার, শারমিন মুর্শিদ এবং নূরজাহান বেগম। পাঠক চলুন সংক্ষিপ্ত আকারে জেনে নিই এই চার নারী উপদেষ্টার কর্মময় জীবনের কথা।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)-এর প্রধান নির্বাহী এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা তৈরির জন্য ২০০৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রথমবারের মতো আয়োজিত ‘পরিবেশ পুরস্কার’–এ ভূষিত। তাঁর পরিচালিত সংগঠন ‘বেলা’ ২০০৩ সালে জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম ঘোষিত ‘গ্লোবাল ফাইভ হান্ড্রেড রোল অফ অনার্স’ পুরস্কারে ভূষিত হয়। এছাড়াও প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০০৯ সালে তিনি ‘পরিবেশ বিষয়ক নোবেল’ খ্যাত ‘গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ’ লাভ করেছেন। তাঁর এসব বহুমুখি কর্মকান্ডের ফলস্বরূপ ২০০৯ সালে বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে ‘হিরোজ অফ এনভায়রনমেন্ট’ খেতাবে ভূষিত করে। পাশাপাশি তিনি ২০১২ সালে এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসেবে বিবেচ্য ফিলিপাইনভিত্তিক ‘রামোন ম্যাগসেসে’ পুরস্কার লাভ করেন। সর্বশেষ তাঁর মুকুটে যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক সাহসী নারী পুরস্কার (২০২২)।
ফরিদা আখতার
চট্টগ্রামের সন্তান বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)’-এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার । তিনি একাধারে একজন লেখক, গবেষক ও আন্দোলনকর্মী। ফরিদা আখতারের জন্ম চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার হারলা গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের অবস্থা জানা এবং পরিবর্তনের জন্য নীতিনির্ধারণী গবেষণা ও লেখালেখিই তাঁর কাজের প্রধান জায়গা। নারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য সম্পদ, তাঁত শিল্প, গার্মেন্টস শিল্প ও শ্রমিক, জনসংখ্যা এবং উন্নয়নমূলক বিষয়ে নিবিড়ভাবে দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করছেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে পরিচালিত কার্যক্রমের মারাত্মক কুফল ও নারী স্বাস্থ্যের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে লেখালেখি এবং প্রতিকার আন্দোলনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে সুপরিচিত ফরিদা আখতার। তিনি বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে নারী ও গাছ, কৈজুরী গ্রামের নারী ও গাছের কথা। উল্লেখ্য তিনি লেখক ও কলামিস্ট ফরহাদ মাজহারের সহধর্মিণী।
শারমিন মুর্শিদ
সামাজিক পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ অধিকারভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুর্শিদ। ‘ব্রতী’ সংগঠনটি বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ দলেরও অন্যতম সদস্য। সম্ভ্রান্ত পরিবারে বেড়ে উঠা শারমিন মুর্শিদের। তাঁর মা নূরজাহান মুর্শিদ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। পরে ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সংসদে সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। তাঁর পিতা খাঁন সারওয়ার মুর্শিদ ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের সকল গণ–আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্য রূপকারদের তিনি একজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন খাঁন সরওয়ার মুর্শিদ।
নূরজাহান বেগম
গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান নূরজাহান বেগম । তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্প শুরুর সময় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মোহম্মদ ইউনূসের প্রথম সারির সহযোগীদের একজন। গ্রামীণ ব্যাংকের তৃণমূলে দরিদ্র গ্রামীণ মহিলাদের সংগঠিত করা ও প্রশিক্ষণ প্রদানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি গ্রামীণ পরিবারের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শিক্ষা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অনেক দেশে মাইক্রো–ক্রেডিট প্রোগ্রামের পরামর্শদাতা, প্রশিক্ষক ও মূল্যায়নকারী হিসাবে কাজ করেছেন এবং বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, সম্মেলন ও সেমিনারে বক্তব্য দিয়েছেন। গ্রামীণ ফাউন্ডেশন কর্তৃক সুসান এম. ডেভিস লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন ২০০৮ সালে। এছাড়াও ওয়ার্ল্ড সামিট মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস অ্যাওয়ার্ড ২০০৯ এবং ভিশন অ্যাওয়ার্ড ২০০৯–এ ভূষিত হন।
আজাদী পরিবার এবং নারী পাতার পক্ষ থেকে সম্মানিত এই চার নারী উপদেষ্টার প্রতি রইল প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। আমরা আশা করছি আগামীর দিনগুলোয় তাদের বলিষ্ঠ পরিচালনায় নারীমুক্তি তথা নারী উন্নয়ন এবং অবশ্যই সামগ্রিক উন্নয়ন আরও বেগবান হবে।
সম্পাদনা: আজাদী নারী ডেস্ক