সড়কে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ যে নিহত হচ্ছে তাই না, অনেকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। এই ধরনের অকাল মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব চাইলেই রোধ করা যায়। প্রতিটি মানুষের প্রাণ মহামূল্যবান। তাই আমরা চাই না, সড়ক দুর্ঘটনায় আর একটি মানুষের প্রাণও ঝরে পড়ুক। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দল–মত, ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে মৃত্যু সব সময়ই কষ্টদায়ক এবং হৃদয়বিদারক হওয়া সত্ত্বেও আমরা সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে মৃত্যুর সঙ্গেও খানিকটা স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলে ফেলেছি। মৃত্যু এখন আমাদের আর আগের মতো বেদনাকাতর করে তোলে না; চোখের কোণে নিজের অজান্তেই অশ্রু উৎপাদন করে না; কিংবা ভেতরে মানবিক খারাপ–লাগা বলে যে একটা অনুভূতি আছে, সেটাও খুব একটা তীব্রভাবে আর কাজ করে না। চতুর্দিকে নিত্য মৃত্যুর ঘটনা দেখে মৃত্যু সম্পর্কিত আমাদের অনুভূতিগুলো খানিকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। কেননা চারপাশে কারণে–অকারণে প্রতিদিন এত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এবং সংবাদপত্রে প্রতিদিন এত মানুষের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়, মৃত্যু মানুষের মধ্যে যে ধরনের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়ার কথা, সেটাও অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে সামপ্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ক্রমান্বয়ে এত লম্বা হচ্ছে, আমাদের ভেতরে যে মাত্রার প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়ার কথা এবং যে মাত্রার বেদনাবিধূর অনুভূতি থাকার কথা, সেটা আমাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। কেননা মৃত্যু এখন আমাদের নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দেশে ক্রমাগতভাবে ক্রমবর্ধমান হারে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ঘটছে; কিন্তু কোনোভাবে এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। ফলে এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান এবং আমাদের অনুভূতি ক্রমহ্রাসমান। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে আর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমাদের যন্ত্রণা এবং কাতরতা ক্রমান্বয়ে কমছে। এটা একটি সমাজের পতনের অন্যতম স্মারকচিহ্ন। গত ২৪ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত মার্চ মাসে সারাদেশে ৫৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, এসব দুর্ঘটনায় ৬১২ জন নিহত ও ১২৪৬ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া রেলপথে ৪০টি দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়েছেন। নৌ–পথে ৮টি দুর্ঘটনায় ১৮ জন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌ–পথে সর্বমোট ৬৪১টি দুর্ঘটনায় ৬৬৪ জন নিহত এবং ১২৫৩ জন আহত হয়েছে। এই সময়ে ২২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২৫১ জন নিহত ও ২০৮ জন আহত হয়েছেন। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৮.২৭ শতাংশ, নিহতের ৪১.০১ শতাংশ ও আহতের ১৬.৬৯ শতাংশ।
চলতি মাসে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ঢাকা বিভাগে ১৪৮ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫০ জন নিহত ও ৩৬৪ জন আহত হয়েছে, সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। বরিশাল বিভাগে ৩১ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত ও ৮৬ জন আহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ট্রাফিক আইনের অপপ্রয়োগ, দুর্বল প্রয়োগ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনিয়ম দুর্নীতি ব্যাপক বৃদ্ধি; মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও তিন চাকার যানের ব্যাপক বৃদ্ধি ও এসব যানবাহন সড়ক মহাসড়কে অবাধে চলাচল; সড়ক–মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কে বাতি না থাকা, রাতের বেলায় ফগ লাইটের অবাধ ব্যবহার; সড়ক–মহাসড়কে নির্মাণ ক্রটি, ফিটনেস যানবাহন ও অদক্ষ চালকের হার ব্যাপক বৃদ্ধি; ফুটপাত বেদখল, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা; উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি এবং অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সতর্কতা ও সচেতনতার অভাব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির অন্যতম প্রধান কারণ হওয়ায় পথচারী, যাত্রী, চালক, সবাইকে সচেতন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। গণমাধ্যমে এমনভাবে প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সবাই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে পথচারী ও যাত্রীদের অধিক সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। তারা সচেতন হলে প্রায় অর্ধেক দুর্ঘটনা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।