পত্রমিতালী; কেবলই এক নস্টালজিয়া

সাজিদুল হক | সোমবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:২৯ পূর্বাহ্ণ

পত্রমিতালী’ শব্দটা শুনলেই কেমন যেন শিহরিত হই। আমরা যখন স্কুল কলেজে পড়ছি তখনও পত্রমিতালী ছিল। বই আদানপ্রদানের নামে ভেতরে চিঠিচালাচালি ছিল কার্যকর পদ্ধতি। এরপর এল ল্যান্ডফোন আর তারপর মুঠোফোন। খুদে বার্তা পেরিয়ে এখন তো ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ওয়ার্টস এপ, ভাইবার সহ আরো অনেক এপ্সের যুগ। মাধ্যমের বিবর্তন যাই হোক, ভালোবাসার আবেগের প্রকাশ ঘটবেই, থাকবে গান, থাকবে কবিতা। আমার ভাবতে অবাক লাগে আমাদের সময়কালেই ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম চোখের সামনে কীভাবে বদলে গেল। এখন আর আবেগের কথা চিঠিতে প্রকাশ করে না। এখন কাগজকলমের স্পর্শে লেখা কবিতা প্রিয় মানুষের কাছে ডাকহরকরা নিয়ে আসে না। চিঠি লেখাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য কালজয়ী গানকবিতা ও প্রবন্ধের জন্ম হয়েছিল। সময়ের পরিবর্তনে সেই গানের কথা ও সুর হারিয়ে যেতে বসেছে। তেমনি এক কালজয়ী গানের কথা ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিওন, নাইরে টেলিগ্রাম, বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম’এই গানের কথা ও সুর বাস্তবে রূপ নিয়ে আজ গ্রাম বাংলার অতীতের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ডাক বিভাগ আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ঝিমিয়ে পড়েছে। শহরের অনেক জায়গায় ডাকবাঙ দেখা যেতো। কালের বিবর্তনে ডাকবাঙ এখন ইনবঙে পরিণত হয়ে গেছে আমাদের সবার কাছে।

৯০এর দশক পর্যন্ত পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চিঠি ছিল অজানাঅচেনা কারো সাথে বন্ধুত্ব করার এক মাধ্যম। সেইসময় বাংলাদেশের প্রায়সব দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রায়প্রতিদিনই বন্ধুত্বের প্রত্যাশায় নাম ও ঠিকানা দিয়ে ছোট ছোট বিজ্ঞাপন ছাপা হতো, বিশেষ করে ম্যাগাজিনগুলোতে। পত্রমিতালী করতে চাই। আমার মনে আছেবিচিত্রা বা সেবা প্রকাশনীর মতো নামী ম্যাগাজিনে বন্ধু করতে চাই পত্রমিতালীর প্রচুর বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। বিশেষত ছাত্রছাত্রীরা এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে পত্রমিতালীর মাধ্যমে বন্ধু খুঁজে নিতেন। প্রযুক্তির কারণে এখন মানুষের মধ্যে হাতে লেখা চিঠির প্রবণতা অনেক কমে গেছে। আমি পত্রমিতালী, ডাকহরকরা দেখেছি। এইতো সেইদিনের কথা ৯৮/৯৯ সালে ডিবি লটারি আর উচ্চ শিক্ষার্থের জন্য আমেরিকা আর ইংল্যান্ডের মতো অনেক নামীদামী ইউনিভার্সিটিতে অফার লেটার পাঠানোর জন্য হাতে লেখা চিঠি পোস্ট করেছি চট্টগ্রাম জিপিওতে গিয়ে। আমার ছেলের জন্ম ২০১৭ সালে তাকে আমার যুগে ডাকহরকরা বা ডাকপিয়ন দেশবিদেশের চিঠি নিয়ে যে আসতো বাসায় সেটা বিশ্বাস করানো যাবে না। আমি ঠিক করেছি চিঠি লেখে আমার ছেলের নামে আমার ঠিকানায় চিঠি পোস্ট করে রাখবো। সে যেনো উপলব্ধি করতে পারে ডাকবিভাগ, চিঠি ও ডাকহরকরা নামক বাংলাদেশে ছিল। আমরা যে সময়টাতে বড় হয়েছি, আমাদের চারপাশে এমন প্রচুর ঘটনা দেখেছি। বড় ভাইবোন তাদের বন্ধুবান্ধব অনেকেরই পত্রমিতা ছিল। পত্রমিতালীর মাধ্যমে বন্ধুত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনি পত্রের মাধ্যমে শিল্প সাহিত্যের উদ্ধৃতি, কবিতা ও সুন্দর হাতের লেখা ছেলেমেয়েরা একে অপরকে উপহার দেওয়ার চেষ্টায় থাকতো।

প্রযুক্তির ব্যবহার কারণে আমরা যখন ডাকবিভাগের মাধ্যমে চিঠি নিয়ে আসা ডাকহরকরার কথা ভুলতে বসেছি। ঠিক সেই মুহূর্তে রোটার‌্যাক্ট ক্লাব অফ চিটাগং লেক সিটির অষ্টাদশ অভিষেক অনুষ্ঠান পত্রমিতালীর মাধ্যমে করার যে পরিকল্পনা নিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। সতর বছর আগে করা ক্লাব বন্ধুত্বের মাধ্যমে বেঁচে থাকুক তাদের কর্মেগুণে। খামের উপর অন্যের হাতে লেখা নিজের নাম। বন্ধুত্বের পত্রমিতালী ডাকবিভাগের মাধ্যমে ডাকহরকরা পৌঁছে দিবে বন্ধুদের। পুরনো দিনের স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া কিংবা হৃদয়ের উষ্ণ আবেগ নিয়ে আসা সেই চিঠিতে লেখা একটি গান ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে, ও সে তো মুখ খুলে নি’ এখন কেবলই এক নস্টালজিয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে লোকাল ট্রেন চাই
পরবর্তী নিবন্ধজীবনের গতিধারা