করোনাভাইরাস আর যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত। দিনযাপন শঙ্কাযুক্ত হয়ে পড়েছে। কেননা তাদের ওপর ভর করেছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। করোনাভাইরাস মোকাবেলা করে দেশের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করা গেলেও বেকার হয়ে যান অনেকে। পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি ব্যবসা–বাণিজ্য। এতে করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যায় শ্রমজীবী মানুষজন। এরমধ্যে এসে যায় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। এই অর্থনৈতিক দুর্বল অবস্থায় দেশে দেখা দিয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবছর বা প্রতি মাসে তো বটেই প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। লাগামহীন আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্যে বিপর্যস্ত হয়ে জনজীবনে উঠেছে নাভিশ্বাস। প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আর এ মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্যের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। কিন্তু খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, মাংস, তরকারি ইত্যাদি নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনজীবনের গতিকে অচল ও আড়ষ্ট করে তুলেছে। পণ্যমূল্যের বৃদ্ধির ফলে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষজন। পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে চাল কিনলে তেল কিনতে পারেন না, তরকারি কিনলে চাল কিনতে পারেন না। মোট কথা হলো পণ্যমূল্য বেড়েছে কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি বরং ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এর ফলে সমাজে আয় বৈষম্য দেখা দিয়েছে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের মনে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ ও উদ্বেগ। চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদন হওয়ার পরও দাম বেড়ে যায়। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা যায় এর পেছনে সিন্ডিকেট দায়ী।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষের আয় ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের মধ্যে একটা বড় ব্যবধান রচিত হয়েছে। একারণে দৃশ্যত বাজারে কোনো পণ্যের অভাব না থাকলেও মানুষ তা কিনতে পারছে না। সামর্থের অভাবই এখানে প্রধান। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দৈশিক ও বৈশ্বিক কারণ যাই হোক, তা এতটা বাড়ার কথা নয়। বেড়েছে ও বাড়ছে এক শ্রেণীর অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে। বলা বাহুল্য, দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নবিত্তের মানুষের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তা এতটাই শোচনীয় যে, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মধ্যবিত্তের মানুষও দিশাহারা অবস্থায় পতিত হয়েছে। করোনার কারণে আগে থেকেই দ্রব্যমূল্য ক্রয়সামর্থের বাইরে চলে গিয়েছিল অধিকাংশ মানুষের। তাছাড়া রাশিয়া–ইউক্রেন যুুদ্ধ মূল্যপরিস্থিতিকে রীতিমত ভয়াবহ অবস্থায় নিয়ে গেছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ নিত্যপণ্যের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধিতে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছে।
সামনে রমজান। এরমধ্যে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি শুরু করেছেন বলে ২৬ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে। এতে বলা হয়েছে, ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। রমজানের বাজার ধরার জন্য ব্যবসায়ীরা দুই আড়াই মাস আগে থেকে পণ্য গুদামজাতকরণ শুরু করেন। পরবর্তীতে সেইসব পণ্য ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করবেন তারা। তবে এবারের চিত্রটা ভিন্ন বলছেন ব্যবসায়ীরা। ডলার সংকটের অজুহাত দেখিয়ে অনেক ব্যাংকই আগের মতো এলসি (ঋণপত্র) খুলছেন না। যার ফলে রমজানের পণ্য আমদানিতে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে। তাই স্বাভাবিকভাবে রমজানের পণ্য সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা। খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকরা বলছেন, পণ্য বুকিং থেকে শুরু করে গুদামে আসা পর্যন্ত দেড় থেকে দুইমাস সময় লাগে। গত বছরের এই সময়ে ব্যবসায়ীরা প্রচুর পরিমাণ ছোলা, মটর ও মসুর ডাল গুদামজাত করে। কিন্তু এ বছর সেই ব্যস্ততা নেই। তবে বাজারে পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। তাই রমজানে দামও সহনশীল পর্যায়ে থাকবে।
রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে উৎসব–পার্বণ উপলক্ষে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয় নিত্যপণ্যে ও অন্যান্য সামগ্রীতে। দাম কমানো হয় পণ্যসামগ্রীর। সেখানে আমাদের দেশে প্রত্যক্ষ করি বিপরীত চিত্র। উৎসব–পার্বণে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেওয়া যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা অপকৌশলে। ভোক্তাদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে নির্দ্বিধায়, ঠকানো হচ্ছে অনবরত। আগামী রমজান উপলক্ষে অসাধু ব্যবসায়ীদের সমস্ত কারসাজি রুখে দিতে হবে। কেননা তাদের তৎপরতা নিতান্তই অন্যায় ও অযৌক্তিক। অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।