দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা বিদেশ থেকে আসেনি। নানা ধরনের জালিয়াতির কারণে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশি বায়ার এবং বায়িং হাউজসহ সংঘবদ্ধ চক্র মেরে দিয়েছে। পণ্য রপ্তানি করেও টাকা না পেয়ে দিশেহারা অনেক গার্মেন্টস মালিক ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কারখানা।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের এক গার্মেন্টস মালিক একইভাবে প্রতারিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীর সিরাজউদ্দৌলা রোডের কে গার্মেন্টস কারখানায় উৎপাদিত তৈরি পোশাক বন্দরে জাহাজিকরণসহ সবকিছু ঠিকভাবে করা হয়। প্রায় ৩ কোটি টাকা দামের দুই কন্টেনার পণ্য পৌঁছে যায় আলজেরিয়ার বন্দরে। কিন্তু আলজেরিয়ার বায়িং হাউজের প্রতারণার কারণে রপ্তানিকারক কে গার্মেন্টসের মালিক এক টাকাও পাননি। বেশ কয়েক মাস ধরে রপ্তানিকারক টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছেন, কিন্তু উক্ত বায়িং হাউজ এবং তাদের এদেশীয় প্রতিনিধির অসহযোগিতায় সেটা সম্ভব হয়নি। ফলে এক্সপোর্ট ওভারডিউ হওয়ায় উক্ত রপ্তানিকারক নতুন করে কোনো ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক উক্ত রপ্তানিকারকের সকল ধরনের আমদানি কার্যক্রম স্থগিত করে দিয়েছে। এতে করে আগামী মাস থেকে ওই রপ্তানিকারকের কারখানা চালু রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এতে কয়েক হাজার শ্রমিকসহ কারখানাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিল্পপতি চোখে–মুখে অন্ধকার দেখছেন। তিনি এ বিষয়ে সহায়তা চেয়ে বিজিএমইএকে পত্র দিয়েছেন।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, পণ্য জাহাজিকরণের ছয় মাসের মধ্যে রপ্তানি মূল্য দেশে আসার কথা। ওই সময়ের মধ্যে পণ্যমূল্য ফেরত না এলে এবং কম এলে ব্যাংকে ওভারডিউজ হিসেবে পরিগণিত হবে। আবার অনেক সময় রপ্তানি মূল্যের ডিসকাউন্ট করা হলে কম মূল্য ফেরত আসে। সেক্ষেত্রে বায়ারকে দেয়া ডিসকাউন্ট বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কমিটিকে অবহিত করে অনুমোদন নিতে হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিপিং লাইন্স ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স কর্তৃক আমেরিকা কিংবা সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যাংকের ডকুমেন্ট ছাড়াই বায়ারকে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বায়ার বাংলাদেশের রপ্তানিকারক কর্তৃক তার ব্যাংকে পাঠানো ডকুমেন্ট ছাড় না করে স্থানীয় ফরোয়ার্ডার্স ও শিপিং লাইনের সঙ্গে যোগসাজস করে পণ্য ডেলিভারি নিয়ে নেয়। কারণ ব্যাংক থেকে ডকুমেন্ট ছাড় করতে পণ্যের সকল মূল্য পরিশোধ করতে হয়। এতে করে বিদেশি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকে পণ্যের মূল্য আসে না। বিদেশি ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ে বায়ার ডকুমেন্ট ক্লিয়ার না করলে তা ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানি চালানের ক্ষেত্রে টাকা ফেরত না এলে সরাসরি ভূমিকা রাখলে এবং বিদেশি বায়ারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিদেশে দূতাবাসকে ব্যবহার করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মামলা করলে অসাধু বায়ার কিংবা রপ্তানিকারক শিপিং লাইন ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অবৈধ কাজ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হবে।
সাম্প্রতিক যে ঘটনাটি আলোচিত হচ্ছে সেটি নগরীর সিরাজউদ্দৌলা রোডের। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কে গার্মেন্টস লিমিটেড আলজেরিয়ায় দুই কন্টেনার পণ্য রপ্তানি করে। ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪শ ৫ ডলার বা প্রায় ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা দামের উক্ত পণ্য আলজেরিয়ার মাজারিন গ্রুপ নামের একটি বায়িং হাউজের মাধ্যমে রপ্তানি করা হয়। গত ফেব্রুয়ারি এবং জুন মাসে দুই দফায় দুই কন্টেনার পণ্য আলজেরিয়ার ওরান বন্দরে পৌঁছায়। কন্টেনার দুটি পৌঁছানোর পর উক্ত বায়িং হাউজ রপ্তানিকারকের পাওনা বা পণ্যমূল্য পরিশোধ না করে সেগুলো খালাসের চেষ্টা করে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে রপ্তানিকারক চালান দুটির খালাস কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে ওরান বন্দর কর্তৃপক্ষ কন্টেনার দুটি আটকে দেয়।
নানাভাবে চেষ্টা করেও রপ্তানিমূল্য উদ্ধার করতে না পারায় কে গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজয় শেখর দাশ উক্ত বায়িং হাউজ এবং তাদের এদেশীয় প্রতিনিধির বিরুদ্ধে ভয়াবহ আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বরাবরে পাঠানো এক চিঠিতে বিষয়টি তুলে ধরে জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
কে গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজয় শেখর দাশ জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও জুন মাসে আলজেরিয়ার ওরান বন্দরের উদ্দেশ্যে দুই কন্টেনার তৈরি পোশাক পাঠান। কার্গোগুলো যথাসময়ে গন্তব্য বন্দরে পৌঁছালেও এখনো পর্যন্ত কোনোটিই গ্রাহকপক্ষ গ্রহণ করেনি। আলজেরিয়ার মাজারিন গ্রুপ নামের একটি বায়িং হাউস নকল পেমেন্ট কাগজপত্র দেখিয়ে বন্দরে থাকা পণ্য ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। একইসঙ্গে অভিযোগ উঠেছে, দুবাইভিত্তিক ক্রেতার কাছ থেকে ওই পণ্যের পূর্ণ মূল্য ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে তারা। কিন্তু কে গার্মেন্টসকে এক টাকাও পরিশোধ করেনি।
বিজয় শেখর দাশ চিঠিতে উল্লেখ করেন, এটি কেবল আমার প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের সুনাম ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি চরম হুমকি। বিষয়টি দ্রুত সমাধানে বিজিএমইএর সদয় হস্তক্ষেপ জরুরি।
তিনি জানান, দুটি কন্টেনারের বিপরীতে রপ্তানির পেমেন্টের সময়সীমা ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে, যা ব্যাংকিং ও বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত আনার নিয়মের ক্ষেত্রে একটি সংকট তৈরি করেছে। দেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রক্রিয়ায় শিপিং এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারসহ নানা প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। অনেক সময় রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ক্রেতাদের সরাসরি যোগাযোগ হয় না। মাঝখানে বায়িং এজেন্ট মধ্যস্থতা করে। রপ্তানি পণ্য বুঝে নিয়ে জাহাজ কোম্পানিগুলো গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়। আর ডেলিভারি এজেন্ট হিসেবে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার আমদানিকারকের হাতে সে পণ্য তুলে দেয়। সেক্ষেত্রে আমদানিকারককে পণ্য ডেলিভারি নেওয়ার আগে ব্যাংকে রপ্তানি পণ্যের মূল্য পরিশোধসহ সব প্রক্রিয়া শেষ করে শিপিং এজেন্টকে মূল বিল অব এঙপোর্ট (রপ্তানি বিল) কপি জমা দিতে হয়।
কে গার্মেন্টস লিমিটেডের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী বায়িং হাউজ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে চাচ্ছে। এ ধরনের অনেক ঘটনা দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ইতোমধ্যে অনেক গার্মেন্টস মালিক প্রতারিত হয়ে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কে গার্মেন্টসও সংকটে পড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতির সুরাহা না হলে আগামী মাস থেকে কারখানা চালু রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
এর আগে চট্টগ্রামের মেলো ফ্যাশন নামে অপর একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪ কোটি টাকার পণ্য আমেরিকার বায়ার ব্যাংক ডকুমেন্ট ছাড় না করে শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স কর্তৃক ব্যাংক ডকুমেন্ট ছাড়া বায়ারকে পণ্য সরবরাহ করে। এদিকে মেলো ফ্যাশন স্থানীয় আদালতে শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্সের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন তদন্ত শেষে শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্সকে দায়ী করে যোগসাজসে পণ্য খালাস নেয় বলে রিপোর্ট দিয়েছে।
মেলো ফ্যাশনের পরিচালক এবং বিজিএমইএর পোর্ট অ্যান্ড শিপিংয়ের ডিরেক্টর ইনচার্জ সাইফ উল্ল্যাহ মনসুর জানান, দেশের টাকা এভাবে বিদেশি প্রতারকরা লুটে নিয়ে বিপুল সংখ্যক গার্মেন্টস মালিককে পথে বসিয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিজিএমইএ, কাস্টমস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান। বিষয়টি নিয়ে গতকাল এনবিআরের সাথে বৈঠক করেছেন বলে জানান।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহসভাপতি এবং গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এ এম মাহবুব চৌধুরী নিজেও এ ধরনের দুটি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তার চার লাখ ডলারের পণ্য নিয়ে গেলেও এক টাকা পরিশোধ করেনি। বিষয়টি নিয়ে নানাভাবে দেনদরবার এবং মামলা করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিদেশে আটকে থাকা টাকা উদ্ধার করতে পারেননি তিনি। মাহবুব চৌধুরী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত এক পত্রে রপ্তানির বিপরীতে বিদেশ থেকে টাকা ফেরত না আসার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কাস্টমস, বিজিএমইএ, চেম্বার এবং জেলা প্রশাসনের করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার রপ্তানি চালানের বিপরীতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা দেশে আসেনি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৮(এ) ধারা রহস্যজনকভাবে বিলুপ্ত করে দেয়ায় বিদেশিরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে।
এসব ঘটনায় পোশাক রপ্তানি খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, গার্মেন্টস সেক্টরের অন্তত ৭ বিলিয়ন ডলার বিদেশিরা মেরে দিয়েছে। এ টাকা উদ্ধার করার জন্য সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি। তারা বলেন, এ ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতারণা রোধে সরকার ও বিজিএমইএকে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।