ধীরে ধীরে আমাদের দেশে পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৯ মাসে পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৮ শতাংশ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, চার মাস পর গত মার্চে পণ্য রপ্তানি আবারও নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। গত মার্চে ৪৬৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ কম। তবে মার্চে রপ্তানি নেতিবাচক ধারায় চলে গেলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই–মার্চ) রপ্তানিতে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রোববার পণ্য রপ্তানি আয়ের হালনাগাদে এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে রপ্তানির বড় খাতের মধ্যে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তার বিপরীতে পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত খাদ্য, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ৪ হাজার ১৭২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরের একই সময় পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮৬১ কোটি ডলার। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ৩ হাজার ৫২৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই–মার্চে রপ্তানি হয়েছে ৯২ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানিও বেড়েছে পৌনে ৬ শতাংশ। এ খাতের রপ্তানির পরিমাণ ৩৬ কোটি ডলার।
হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি কমেছে ২৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই–মার্চে রপ্তানি হয়েছে ৮৫ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল। অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে ২১ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ৬৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
গত ২০২১–২২ অর্থবছরে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। চলতি অর্থবছর রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।
রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য আনন্দের ঘটনা। অর্থনীতিবিদদের মতে, এখন দরকার হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা। ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হলে সেটা খুবই সম্ভব। তার আগে চারটি কাজ করতে হবে বাংলাদেশকে– পণ্য বহুমুখীকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ, প্রযুক্তি বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ বহুমুখীকরণ। পণ্য বহুমুখীকরণে সবার আগে পোশাকের বাইরে পাট, চামড়া, সিরামিক ইত্যাদি খাতে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। এরপরেই রয়েছে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়া জাত পণ্য, ওষুধ, বাইসাইকেল, প্লাস্টিক পণ্য, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের বেশিরভাগটাই নির্ভর করে বড় যে দুটি বাজার রয়েছে, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা, সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপরে। সামপ্রতিক যে বিশ্ব মন্দার যে প্রভাব ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে তা হয়তো আরও গভীর হবে।
বাংলাদেশের সরকার রপ্তানি আয় আরও বাড়াতে চায়। সেজন্য নানা উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখনো রপ্তানি আয়ের ওপরে সরকার প্রণোদনা দিয়ে থাকে। কিন্তু রপ্তানি কতটা হবে, তা নির্ভর করে অন্য দেশগুলোয় পণ্যের কতটা চাহিদা রয়েছে তার ওপরে। কিন্তু বিশ্ব মন্দা, ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করার মতো বিষয় তো বাংলাদেশের হাতে নেই।
অর্থনীতি, উন্নয়ন ও বাণিজ্য বিষয়ক লেখক মকসুদুজ্জমান লস্কর বলেছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে রপ্তানি ঝুড়িতে শুধু একটি পণ্যের আধিপত্য। একটি পণ্য দিয়ে বাজার সমপ্রসারণ করা বেশ কঠিন। চীন, ভারতসহ প্রতিশ্রুতিশীল বাজারে প্রবেশের জন্য এসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনে উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রপ্তানি আয়ের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য রপ্তানির নতুন গন্তব্য সৃষ্টি কিংবা বিদ্যমান গন্তব্যগুলোকে কীভাবে আরও সমৃদ্ধ করা যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া রপ্তানির ঝুড়িতে বিশ্ববাজারে প্রবেশে সক্ষম এমন পণ্যের সম্ভার বাড়াতে হবে।