প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে জানিয়ে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ইচ্ছা করে বাজারে পণ্য না এনে চক্রান্ত চলছে বলে তাঁর সন্দেহ। যারা এমন করছে তাদেরকে খুঁজে বের করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। গত ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবসে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের আলোচনায় এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মালপত্র থাকার পরে বাজারে না এনে জনগণের পকেট কাটার চেষ্টা করে। এদেরকেও খুঁজে বের করতে হবে। নানাভাবে চক্রান্ত করছে বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, মাছ, মাংস, ডিম, তরিতরকারি, সবজি, চাল, প্রত্যেকটার উৎপাদন বেড়েছে। তাহলে কীসের অভাব হবে? চক্রান্ত কীভাবে হচ্ছে? তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, রেখে দেবে (পণ্য), কিন্তু বাজারে আনবে না। না এনে দাম বাড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলবে। এটাই তারা করে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। উৎপাদন এতটুকু কমেনি, সেটা আলু বলেন, চাল বলেন, পেঁয়াজ বলেন, সবই উৎপাদন আমরা বাড়িয়েছি।
আসলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত মানুষ কীভাবে যে জীবন ধারণ করছে সেটা কল্পনা করা যায় না। মানুষের সঞ্চয় তলানিতে পড়েছে বা শেষ হয়ে গেছে। ধার–কর্য করছে। মানুষ কষ্টে আছে। ব্যবসায়ীদের অতিলোভ বাজার দরের বৃদ্ধির কারণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও দেশের বাজার ব্যবস্থা মনিটরিংয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম সংশ্লিষ্টরা দেখতে পান না। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান বাজারে রাজত্ব কায়েম করেছে। তারা ক্রমেই একচেটিয়া হয়ে উঠছে। অভিযোগ উঠেছে, এই সিন্ডিকেটকে প্রচ্ছন্ন সহায়তা দিচ্ছে সরকার। অনেকক্ষেত্রে সরকার নিজেই এই সিন্ডিকেটকারীদের পৃষ্ঠপোষক। রাষ্ট্র যতক্ষণ না পর্যন্ত বাজারে নিজের সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত বাজারের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডিম সিন্ডিকেট, ডাব সিন্ডিকেট, স্লাইন সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে মানুষের মৌলিক চাহিদাকে ভুলুন্ঠিত করে দেশে যে সিন্ডিকেট মাফিয়া চক্র গড়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে সর্বসাধারণকে সোচ্চার হতে হবে। তাঁরা বলেন, আজকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে দেশের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। একদল সিন্ডিকেট মাফিয়াদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে দেশের মানুষ। কোথায় নেই এই সিন্ডিকেট। এই চক্রের হাতে সাধারণ মানুষ আজ জিম্মি। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনিক ও সরকারি কোনো উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ে না। যা–ও আমরা প্রত্যক্ষ করি, সেটা শুধুমাত্র লোকদেখানো ও বুলি আওড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা মনে করি, এই অবস্থার অবসান হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেছিলেন, দ্রব্যমূল্যের আগুনে দাহ হওয়া ভোক্তাদের কেবল বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। সরকার বলছে সিন্ডিকেট নেই। কিন্তু কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে সেটা কি সিন্ডিকেট নয়। গত অর্থ বছরে সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে সরকার ৯৯ হাজার কোটি টাকা লোন নিয়েছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে লোন নেয়া মানে সেন্ট্রাল ব্যাংকের টাকশাল থেকে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে লোন দেওয়া। বাজারে যদি মানি সাপ্লাই বাড়ে তাহলে পণ্যমূল্য বাড়ে। দ্রব্য মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয় বাড়লেও কর্মসংস্থান তৈরি হলে ভোক্তাদের কষ্ট কম হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সিন্ডিকেট এক আতঙ্কের নাম। মাঝে মাঝে মনে হয় এই সিন্ডিকেটের কাছে শুধু ক্রেতা সাধারণ নয়, সরকারও জিম্মি হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা ভোক্তা অধিকারকে দেখতে পাই কাঁচামরিচ, ডিম, ডাব বিক্রেতাদের নিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে হুঁশিয়ারি দিতে। কিন্তু যেসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চিনি, ভোজ্যতেল, ডিম এবং ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, যাদের কারসাজিতে পাইকারি বা খুচরা ব্যবসায়ীরা সঠিক মূল্যে পণ্য পায় না সেই সকল কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকারকে আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে। তা নাহলে মনে হতে পারে বড় বড় কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বাজার ব্যবস্থাপনা জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা কোনোভাবে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নয়। তারা বড় বড় পুঁজি নিয়ে বাজারে আসে। লাভ যেমন থাকে ঝুঁকিও তেমনি থাকে। তাই ভ্যাট–ট্যাক্স ব্যবস্থাপণাকে সহনীয় রেখে সরকারকে বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ করে দিতে হবে। একই সাথে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে নতুন বিনিয়োগকারীদের সহযোগিতা প্রদান করে বাজার সিন্ডিকেট বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।