সিলেটের কানাইঘাটে সাত দিন ধরে নিখোঁজ এক শিশুর মরদেহ বাড়ির পাশের খাল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। গত শনিবার ভোর রাত ৩টার দিকে খালে পুঁতে রাখা শিশুটির নিথর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় শিশুটির গলায় রশি পেঁচানো ছিল বলে জানিয়েছেন কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল। নিহত ছয় বছর বয়সী মুনতাহা আক্তার জেরিন উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরদল গ্রামের ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে।
শামীম জানান, গত ৩ নভেম্বর সকালে তার সঙ্গে স্থানীয় একটি ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরে শিশু মুনতাহা। পরে আশপাশের বাড়িতে শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে যায়। কিন্তু বিকাল হলেও বাড়ি না ফিরলে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। তারপর তাকে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। পরে এ ঘটনায় কানাইঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেছিলেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
শিশুটি নিখোঁজের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তাকে উদ্ধারের আহ্বান জানান অনেকে। শিশুটির খোঁজ দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন কয়েকজন প্রবাসী।
পড়াতে নিষেধ করায় হত্যা : গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম মার্জিয়ার কাছে পড়াতে নিষেধ করার ক্ষোভ থেকে শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করছেন তার বাবা শামীম আহমদ। ওই ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল। গ্রেপ্তাররা হলেন নিহত মুনতাহারের সাবেক গৃহশিক্ষক শামীম বেগম মার্জিয়া (২৫), তার মা আলিফজান বিবি (৫৫), ছইদুর রহমানের ছেলে ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুনুর রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগম (৩৫)।
ময়নাতদন্ত শেষে শিশু মুনতাহার লাশ দাফন করা হয়েছে। তাকে হত্যার ঘটনায় তার বাবা বাদী গ্রেপ্তার চারজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
গতকাল বিকালে মুনতাহার লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে নিয়ে গেলে সেখানে আত্মীয়–স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে উপস্থিত এলাকার শত শত লোকজন এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানান। পরে জানাজা শেষে বাদ আসর মুনতাহার লাশ বীরদল পুরানফৌদ জামে মসজিদে গ্র্রামের পঞ্চায়েত কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শামীম বলেন, আমার মেয়ের এক সময়ের গৃহশিক্ষিকা ছিল আলিফজান বিবির মেয়ে শামীমা আক্তার মার্জিয়া। কিন্তু মার্জিয়ার খারাপ আচরণের কারণে মেয়েকে তার কাছে পড়াতে নিষেধ করি। এতে সে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুনতাহাকে মার্জিয়া ও তার মা আলিফজান কৌশলে তাদের বসতঘরে নিয়ে যায়। পরে তার মুখে ওড়না ঢুকিয়ে এবং গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর লাশ বস্তাবন্দি করে ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। গভীর রাতে তারা আমার মেয়ের লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে ঘরের পাশে খালের নর্দমায় পুঁতে রাখে।
তিনি বলেন, মুনতাহা নিখোঁজের পর একাধিকবার মার্জিয়াসহ তার পরিবারের কাছে আমার মেয়ের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু তারা একেকবার একেক ধরনের কথা বলতে থাকে। পরে মার্জিয়ার পরিবারের লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে শনিবার রাতে পুলিশ মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, মার্জিয়াকে থানায় নেওয়ার পর তার মা আলিফজান মুনতাহারের পুঁতে রাখা লাশ তুলে পাশের বাড়ির পুকরে ফেলার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় আলিফজানকে হাতে–নাতে আটক করেন স্থানীয়রা। তাৎক্ষণিক থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলিফজান ও তার মা কুতুবজান বিবিকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
ওসি আব্দুল আউয়াল বলেন, আলিফজান ও মার্জিয়ার দেওয়া তথ্যে ইসলাম ও নাজমা বেগমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পড়াতে নিষেধ করার ক্ষোভ থেকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরও কোনো কারণ থাকতে পারে। পুলিশ ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে; তাই তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলা যাচ্ছে না।
এদিকে গতকাল দুপুরে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান মুনতাহার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোকজনকে সান্ত্বনা দেন ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় স্থানীয় লোকজন হত্যাকারীদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান তার কাছে। পরে পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের বলেন, মুনতাহাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। তার হত্যাকারী চারজনকে এরই মধ্যে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের প্রত্যেককে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
এদিকে লাশ উদ্ধারের পর মর্জিয়াদের বসতঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে ক্ষুব্ধ জনতা। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহিদ বলেন, ঘটনার দিন রোববার আমার বাড়িতে খেলা করছিল মুনতাহা। আমাদের বিশ্বাস ছিল শিশুটিকে জীবিত পাব। কিন্তু তাকে হত্যা করা হবে, ঘরের পাশে তার মরদেহ মিলবে, কল্পনাও করিনি। তিনি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন।