নানা জাতের পাখি, গাছগাছালি আর লতাপাতায় ভরা এই এলাকায় এক সময় ছিল পরিদের আনাগোনা। সেই পরিরা প্রায় দুশো বছর আগে এখানে রাতারাতি খনন করেছিল এক দিঘি, যেটা পরির দিঘি নামে খ্যাত।
পটিয়া পৌরসভা বাস স্টেশনে নেমে পটিয়া সরকারি কলেজের দক্ষিণ–পূর্ব গেটসংলগ্ন হাতের ডানে পটিয়া–আনোয়ারা সড়ক ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার গেলেই পাইকপাড়া গ্রাম। স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ড কার্যালয়ের পাশেই সেই পরির দিঘি। এখন সেই ইউনিয়ন বোর্ড কার্যালয়ও নেই, নেই স্বপ্নময় বিশাল দিঘির অবয়ব। আছে দিঘির চিহ্ন বুকে ধারণ করে মাঝারি আকারের একটি পুকুর। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি রেইনট্রি আর দিঘি নিয়ে লোকমুখে ছড়ানো গল্পগাথা।
দিঘি থেকে একটু সামনে এগিয়ে বাঁ দিকে পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পাশের বাসিন্দা ছালেহ আহমদ (৯০) এবং তোফায়েল আলী মুন্সি ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি ও পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মুজিবুল ইসলাম চৌধুরী নিরু জানালেন সেই দিঘি নিয়ে কিংবদন্তি–
যে রাতে দিঘিটি খনন করা হয় সেটি ছিল অমাবস্যার রাত। একদিকে সারারাত ধরে পরিরা দিঘি খনন করছিল, অন্যদিকে এক বাড়িতে চলছিল ঢেঁকিতে চাল ভাঙা, পরদিন সকালে মেহমানদের খাওয়াবেন বলে। রাত শেষ হওয়ার আগেই তিন পাড়সহ দিঘিটি খনন হয়ে যায় উত্তর পাড় ছাড়া। সকালবেলা মানুষ আশ্চর্য হয়ে দেখল, পানিতে টইটম্বুর বিশাল এক দিঘি। কিন্তু পরিরা কোথাও নেই। ধারণা করা হয়, এলাকাবাসী দেখে ফেলবে মনে করে পরিরা সকাল হওয়ার আগে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে উত্তর পাড়ে একটি সড়ক তৈরি হয় যার নাম মোহাম্মদ জামান সিকদার সড়ক।
ছালেহ আহমদ পরির দিঘি নিয়ে শোনালেন আরো কিছু কিংবদন্তি, যেমন সে সময় বিয়ে–শাদি কিংবা মেজবানে ব্যবহারের জন্য কেউ পরিদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়ে হাত বাড়ালেই দিঘি থেকে ভেসে উঠত মাটির হাঁড়ি, পাতিল, থালাবাসন। তবে শর্ত ছিল ব্যবহারের পর সব জিনিসই দিঘিতে রেখে আসতে হবে। সে অনুযায়ী সবকিছু চলছিল। কিন্তু একবার নাকি অনুষ্ঠানের পর স্থানীয় কেউ একজন একটি থালা চুরি করে রেখে দেয়। সেই থেকে আর কখনো থালাবাসনসহ কোনো জিনিস ভেসে ওঠেনি।
পরির দিঘি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম কে মোহাম্মদ ফেরদৌস জানান– এই দিঘি ছিল এলাকার তৎকালীন হিন্দু জমিদার প্রবুদ্ধ কুমার দাশের। দিঘির মোট আয়তন ছিল প্রায় তিন একর বা সাড়ে সাত কানি। দিঘির জায়গার ওপর পরবর্তী সময়ে স্কুল, পথঘাট ও বসতবাটী গড়ে ওঠে। ফলে দিঘির বেশির ভাগ ভরাট হয়ে বর্তমানে তিন কানির মতো জলাংশ অবশিষ্ট আছে। এক সময়ে এই দিঘিটি কিনে নেন জমিদার মাহমুদ জামান সিকদার। তাঁর ছিল তিন সন্তান। তাঁরা হলেন– তোফায়েল আলী মুন্সী (পাইকপাড়ায় তুফান আলী মুন্সী বাড়ি নামে পরিচিত), বাকস আলী ও করম আলী। তোফায়েল আলী মুন্সীর চার পুত্র– আশরাফ আলী, মোশারফ আলী, ফজর আলী এবং মুখলেছুর রহমান। আশরাফ আলীর আবার তিন পুত্র– ইয়ার আলী, মনির আহমেদ এবং কায়কোবাদ। মনির আহমদ এক সময় ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি দিঘির দক্ষিণ পাড়ে ‘তোফায়েল আলী মুন্সির খেলা’ নামে একটি বলীখেলার প্রচলন করেন– যেটা ‘পরির দিঘির খেলা’ নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তান আমলেই এটি বন্ধ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, বর্তমান পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তোফায়েল আলী মুন্সী ও ভূমিদাতা ছিলেন রায়হান সিকদার। মাহমুদ জামান সিকদারের বংশধরদের কেউ এখন এখানে থাকেন না। তাঁদের অনেকে চট্টগ্রাম শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এই বংশেরই রায়হান আলী মাহমুদের ছেলে মৃত মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। পরবর্তী সময়ে তিনি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরীর তিন সন্তান, তাঁরা হলেন– ডা. আহমেদ আবদুল হান্নান (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), ডা. আহমেদ আবদুল মোবিন (মেডিসিন বিশেষজ্ঞ), তৃতীয় জন আবদুল মতিন ছিলেন তৎকালীন মিউনিসিপালিটির প্রকৌশলী। তাঁরা সবাই থাকেন চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশে।
পটিয়া এখন উপশহরে রূপ নিয়েছে। বেড়েছে লোকসংখ্যা ও জমির দাম। চারদিকে চলছে পুকুর–জলাশয় ভরাট করে বাড়িঘর ও দোকানপাট নির্মাণ করার প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা থেকে বাদ যায়নি ঐতিহ্যবাহী পরির দিঘিও। স্বপ্নের পরির দিঘি এখন অনেকটা মাঝারি আকারের পুকুরে পরিণত হয়েছে। বাকি অংশ ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িঘর, দোকান, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। আসলে পরির দিঘি নিয়ে শোনা গল্প আজও রয়ে গেছে মানুষের স্মৃতির ঝাঁপিতে। সত্যিকারে ঘটনা ছিল– আসলে সে সময় হিন্দু জমিদার প্রবুদ্ধ কুমার দাশ রাতের অন্ধকারে লোকজন দিয়ে রাতারাতি দিঘিটি খনন করেন এবং ভোর হওয়ার আগে দিঘির খনন কাজ শেষ করে শ্রমিকরা চলে যায়। সকালবেলা ঝোপ জঙ্গলের ভিতরে খনন করা দিঘি দেখতে পেয়ে মানুষের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি হয় এবং বলাবলি করতে থাকে– ঝোপ–জঙ্গলে পরিদের আস্তানা ছিল এবং পরিরা এটি রাতারাতি খনন করে চলে গেছে। সেই থেকে এটি পরির দিঘি। পটিয়া পাইকপাড়া গ্রামের পরির দিঘিটি আজও ছবির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গল্পকার।