পটিয়া বাইপাস, যা পটিয়া উপজেলার ব্যস্ততম এলাকাকে পাশ কাটিয়ে একজন যাত্রীকে ইন্দ্রপুল এলাকা থেকে কমল মুন্সীর হাট এলাকায় পৌঁছে দেবে ১০ মিনিটের মধ্যে। সম্প্রতি এই বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হয়। দূরবর্তী যানবাহনের যাত্রীদের কষ্ট লাঘবের পাশাপাশি পটিয়ার আর্থ–সামাজিক উন্নয়নে এই বাইপাস খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই সবাই আশাবাদী। দুই ধাপে নির্মিত এই বাইপাসের প্রথম ধাপে পুরো রাস্তাটা আর দ্বিতীয় ধাপে ইন্দ্রপুল ব্রিজসহ রাউন্ড এবাউট ইন্টারসেকশনটা বানানো হয়।
এই বাইপাস সড়ক নির্মাণে বেশ কিছু আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগানো হয়েছে, নির্মাণের আগে পরিকল্পনার সময়ও বেশ কিছু দূরদর্শী সিদ্ধান্তের প্রতিফলন দেখা যায়, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। উদাহরণস্বরূপ, বাইপাস এর ব্রিজগুলোর কথা তুলে ধরতে চাই। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন, রাস্তার কিছু কিছু জায়গায়, বিশেষ করে ব্রিজগুলোর আগে পরে রাস্তার প্রশস্ততা একটু বেশি, ব্রিজ এবং তার এপ্রোচগুলোতে দুইদিকে দুই লেইন করে মোট চার লেনের রাস্তা বানানো হয়েছে, যেখানে মধ্যবর্তী রাস্তা শুধু দুই লেনের জন্য বানানো। ধারণা করছি ভবিষ্যতে এই বাইপাসের আগাগোড়া চার লেন এর প্রশস্ততা পাবে। তবে এখন হয়তো অর্থ অথবা সময় স্বল্পতার কারণে পুরোটাই চার লেন করা সম্ভব হয়নি। দুইলেন এর রাস্তা যতটা সহজে চার লেন করা যায়, দুই লেন এর ব্রিজ তত সহজে পাশে বড় করা সম্ভব না। ঠিক সে কারণেই এখন ব্রিজগুলো বড় করেই বানানো হয়েছে, পরে সময় সুযোগ বুঝে রাস্তাটা বড় করবে। ডিজাইনার এর এই বিচক্ষণতা প্রশংসনীয়।
তবে আজকে বসেছি ইন্টারসেকশন নিয়ে লেখবো বলে। বাইপাস এর দক্ষিণ পূর্ব পাশের ইন্টারসেকশন, যেখানে বাইপাস শেষ হয়ে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের সাথে মিশে যায়, সেটার ডিজাইন নিয়ে কয়েকটা কথা লেখার ইচ্ছা আছে আজকে।
গুগুল ম্যাপের সাহায্যে ইন্টারসেকশন এর বর্তমান অবস্থা দেখতে পেলাম। দেখা যাচ্ছে, মেইন রোডের কাছাকাছি এসে বাইপাসটা দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। অনেকটা ইংরেজি বর্ণমালার ণ এর মতো হয়ে মেইন রোডের দুইদিকে যুক্ত হয়েছে। এ ধরনের ইন্টারসেকশন আমাদের কাছে নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ক্রসিং এবং বাদামতলেও এই ধরনের ইন্টারসেকশন আছে একই মহাসড়কের উপর। এটা নতুন কিছু নয়, অনেক পুরোনো একটা আইডিয়া। তবে মহাসড়কে এই ডিজাইনটা খুবই বিপজ্জনক।
ধরুন, আপনি বাইপাস থেকে মেইন রোডে উঠে শ্রীমাই ব্রিজ হয়ে সরকারি কৃষি অফিসের দিকে যাবেন। আপনি ণ সেকশন এর উপরের মাথা ধরে মেইন রোডে উঠে কৃষি অফিসে চলে গেলেন খুব সহজে। অথবা আপনি কমল মুন্সির হাট থেকে বাইপাস হয়ে ইন্দ্রপুল যেতে চাচ্ছেন। রাস্তার বামপাশ ধরে খুব সহজেই আপনি বাইপাস এ উঠে গেলেন। রাস্তার ওপর পাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার জানার কোনো দরকার আপনার নেই, কারণ ডান পাশের গাড়ি তো আর আপনার লাইনে আসছে না। এই হিসাবে যারা কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম শহরে যাচ্ছে, তাদের জন্য এই বাইপাস খুবই নিরাপদ একটা মাধ্যম। বিশেষ করে বড় গাড়িগুলো (বাস, ট্রাক) এই রাস্তা ব্যবহার করে খুব আরাম পাবে।
যেহেতু ইন্টারসেকশনটা শুধুমাত্র দুই ধরনের যানবাহনের কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করা, বাইপাস থেকে কক্সবাজারগামী গাড়ি অথবা গিরি চৌধুরী বাজার থেকে ইন্দ্রপুল যেতে চাওয়া গাড়িগুলো কী করবে?
এই প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য উত্তর হলো, এই দুইধরনের সুবিধাবঞ্চিত গাড়িগুলো নিয়মভঙ্গ করে বিপদ মাথায় নিয়ে এই বাইপাস এ চলাচল করবে। বাইপাস এই ডিজাইন ত্রুটির কারণে বড় বাস ট্রাকগুলো রাস্তার বাইরে গিয়ে ওয়াইড টার্ন নেবে, বিপরীতমুখী গাড়ির সাথে সংঘর্ষের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তাটা পার হয়ে অন্য পাশের লেনে উঠার চেষ্টা করবে। এই কাজ করতে গিয়ে রাস্তা পার হতে যাওয়া এবং মেইন রোডের চলন্ত, দুই ধরনের গাড়িই বিপদের ঝুঁকির মধ্যে পড়ব। এই ঝুঁকি এড়াতে গিয়ে এই ইন্টারসেকশন এর গাড়িগুলো গতিবেগ সবসময় কম থাকবে। যতই কম গতি হোক না কেন, বিপদের ঝুঁকি কিছুটা হলেও থেকে যায়। আর যেদিন গাড়ি একটু বেশি চলাচল করবে, এই ত্রুটিপূর্ণ ইন্টারসেকশন ডিজাইন এর কারণে রাস্তার এই অংশে ট্রাফিক জ্যাম হবে।
দেশের প্রথম সারির একটা মহাসড়কে এই ডিজাইন পুরোটাই ভুল। আপনি যদি এই রাস্তায় মোটর সাইকেল চালান, অথবা সিএনজিতে চড়েন, আপনার হয়ত মনে হবে না এটা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু। কিন্তু যিনি এই মোড়ের মধ্য দিয়ে বাস চালিয়ে নিয়ে যাবেন, অথবা বড় লরিতে করে পণ্য সরবরাহ করবেন, তার জন্য এই মোড়টা একটা বিশাল সমস্যা। আর জাতীয় মহাসড়কে হরহামেশা বড় ও লম্বা গাড়ি চলবে, সেটা ধরে নিয়েই ডিজাইন করা লাগে। কারণ, ওইসব বড় গাড়িকে ঠিকমত চলতে না দিলে যে এক্সিডেন্টগুলো হয়, সেখানে সাধারণত ছোট গাড়ির আরোহীরা বেশি ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। ইন্টারসেকশনের এই মারাত্মক ভুলটাকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। অথচ এই ইন্টারসেকশন এর ডিজাইন একটু ব্যতিক্রমভাবে করলেই এত্তগুলা অসুবিধা অথবা বিপদের ঝুঁকি থাকতো না, কিছুটা হলেও কমে আসত।
আমার মতে এ রাস্তার অন্য পাশে যাওয়া–আসা করা গাড়ি আলাদাভাবে হিসাব করা উচিত। ঐসব গাড়ি মাঝের চিকন রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে পারবে, তারপর সময় সুযোগ বুঝে রাস্তা পার হতে পারবে। রাস্তার বাম পাশে চলাচল করা গাড়িগুলো আলাদা সুবিধা পাবে ডেডিকেটেড লেন এর কারণে, এপার ওপার করা গাড়িগুলো একটু থেমে নিরাপদভাবে রাস্তা ব্যবহার করতে পারবে ।
এই তো হল, একটা উদাহরণ মাত্র। আরও বেশ কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যায় এই ইন্টারসেকশনের উন্নত ডিজাইন পরিকল্পনার জন্য। সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ডিজাইন হত, ফ্লাইওভার নির্মাণ করলে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যেমন এই বাইপাসের ব্রিজগুলো এখনই প্রশস্ত করে বানানো হয়েছে, একই যুক্তিতে এই ইন্টারসেকশনে দুইটা (ওভার) ব্রিজ নির্মাণ করলে বিপদের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসত। এ রকম আরও অনেক বিকল্প ব্যবস্থা করা যায় যা এই মোড়কে বিপজ্জনক তালিকা থেকে বের করে আনতে পারবে। এমনকি চিরাচরিত তিনরাস্তার মোড়ের মত করেও যদি এই ইন্টারসেকশন ডিজাইন করত, তাহলেও এটা এত অসুবিধা তৈরি করত না। কিন্তু মাঝখানের ত্রিভুজাকৃতির আইল্যন্ডটা বসানোর কারণে এই ইন্টারসেকশন মুহূর্তের মধ্যেই ‘কম–কার্যকরী’ থেকে ‘বিপজ্জনক ও অকার্যকরী’ ইন্টারসেকশনে পরিণত হয়েছে। আপনাকে–আমাকে নাগরিক সুবিধা দেবে বলেই সরকার এই রাস্তা তৈরী করেছে। কিন্তু মাঝখানে কোনো এক অদক্ষ কর্মকর্তা, অথবা কোনো এক অপরিপক্ক প্রকৌশলীর ভুলের কারণে আমরা পুরো সুবিধাটা পাচ্ছি না। আমি চাই যোগাযোগক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হোক। জনগণ সচেতন হলে সরকারি সেবার মান আপনা–আপনি বেড়ে যায়। যত টাকা খরচ করে এই প্রজেক্ট সম্পন্ন করা হয়েছে, তার তুলনায় হয়ত সামান্য কিছু টাকা বেশি খরচ হবে, কিন্তু তাতেই এই এলাকায় যানবাহনের দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। এই ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন সংশোধনে অবিলম্বে উদ্যোগ নেয়া হোক।
লেখক
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (কুয়েট; আরকানসা স্টেট)
আমেরিকার টেনেসি অঙ্গরাজ্যের সড়ক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ