স্বাধীনতা অর্জনের পর সুদীর্ঘ একটা সময় আমরা পার করেছি। কিন্তু ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় চেষ্টা করলেও তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো মেলেনি। অথচ এই বিভীষিকাময় দিনটি বাংলাদেশ তথা বিশ্বের মধ্যে গণহত্যার জঘন্য এক কালরাত। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচালিত অভিযানে প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এখনও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশের ২৫শে মার্চের গণহত্যা। কেন পায়নি সে প্রশ্নের উত্তর যেমন অনেক তেমনি আছে নানা করণীয়ও। গণহত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনা মনে করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও পূর্ব ইউরোপে ইহুদি নিধনের ঘটনাকে। সে সময়ের গণহত্যার ঘটনাটিকে বোঝানোর জন্য ‘হলোকস্ট‘ নামে নতুন একটি শব্দও তৈরি হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় অমানবিক গণহত্যাগুলোর মধ্যে ‘দ্য হলোকাস্ট’, ‘গ্রিক গণহত্যা’, ‘সারবিয়ান গণহত্যা’, ‘হোলোডোমার গণহত্যা’, ‘ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যা’, ‘১৯৭১ সালের বাংলাদেশের গণহত্যা’র নাম উল্লেখযোগ্য। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’–এর মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হন। দুই লাখ নারী নিপীড়ন, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি অত্যন্ত জঘন্য ও নারকীয় ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দীর্ঘ সময় পার হবার পরও সেই গণহত্যার কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। এটি আমাদের জাতীর জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জনকে বিচারের আওতায় আনা যায়নি। এদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হলে প্রয়োজন সেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আর সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো এখনো পাকিস্তান দাবি করে যে, তারা বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা চালায়নি অর্থাৎ একাত্তরের গণহত্যাকে তারা স্বীকারই করে না। এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে হলে প্রয়োজন সরকারি পর্যায়ে নানা প্রকার যোগাযোগ ও নানা ধরনের প্রস্তুতি। মহান ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস সে ইতিহাস বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়েছে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের কারণে। একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কাজ করেছিল বিদেশে অরস্থানরত বেশ কিছু এদেশের দেশপ্রেমিক তরুণ। যার ফলশ্রুতিতে এসেছে একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই একাত্তরের পঁচিশে মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রিয় পর্যায় থেকে দেশ বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের বহুবিধ ভূমিকা রয়েছে। সারাদেশে গণহত্যার যে চিত্র এত বছর পরে তার ছবি বা ভিডিও হয়তো মিলবে না। কিন্তু যে তথ্য প্রমাণ রয়েছে তার ভিত্তিতেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। সেই তথ্য প্রমাণগুলো সংগ্রহ করে গণহত্যার আরো বেশি ডকুমেন্টরি তৈরি করা প্রয়োজন। এই ডকুমেন্টগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে। নিয়ম অনুযায়ী জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাবার জন্য যেভাবে আবেদন করতে হয় সেভাবে আবেদনের পথে অগ্রসর হতে হবে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বেশ কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছে গণহত্যার এ স্বীকৃতি পেতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ ঘোষণা করায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের এখন আর সম্ভব নয় বলে মনে করেন অনেকেই। আমাদের দেশের ইতিহাসে ১৯৭১ এর পঁচিশে মার্চ একটি কালরাত এবং একটি কালো অধ্যায়। পৃথিবীর কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিকভাবে কিছু দিবস পালিত হয়। অর্থাৎ ঘটনাগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিই তার প্রমাণ। মে দিবস দিনটি আমেরিকার শিকাগো নগরীর শ্রমিকদের আত্মত্যাগেরই ফসল। সারা বিশ্বজুড়ে মে দিবস পালনের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ঠিক তেমনি আমাদের মহান একুশের ভাষা শহীদদের সম্মান প্রদর্শন করে সারা বিশ্বের অনেক দেশে নিজ নিজ ভাষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিন বলেন,‘যে দেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তারা ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন ঐ গণহত্যার ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে স্বীকার করে নেয় তখনই কেবল ঐ ঘটনা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বিবেচনায় আসে। একটা গণহত্যাকে তারা (আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়) যখন স্বীকার করে নেয়, সেটা সংসদের মাধ্যমেই হোক বা নির্বাহী সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই হোক, তখন বলা যায় সেটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।’ এজন্য ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে কথা বলে তাদের স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। তারপর জাতিসংঘে এটা উপস্থাপন করার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য সরকার, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়ে একত্রে কাজ করা দরকার। তবে মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশ বিদেশে আমাদের বিরোধীতাকারদের অভাব ছিল না, সব বাধাকে অতিক্রম করেই আমরা আমাদের বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। এ কারণে এ কাজটি করতে গেলে পাকিস্তানের বিরোধীতা থাকবেই, আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব দেশ বিরোধী অবস্থানে ছিল, তাদেরও হয়তো বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে। আর সেই সংকট কাটানোর জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতেই হবে। আমাদের জন্য সুখকর সংবাদ হলো গণহত্যা নিয়ে সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘জেনোসাইড ওয়াচ’তো বাংলাদেশে ২৫ শে মার্চ কালরাতের যে গণহত্যা সে গণহত্যার স্বীকৃতি তারা দিয়েছে এবং এ নিয়ে তারা নাকি জাতিসংঘকেও চিঠি দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রয়োজন সে কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
গত শতাব্দীর প্রথমদিকে আর্মেনিয়ার গণহত্যাসহ রুয়ান্ডা ও যুগোশ্লাভিয়ার গণহত্যা জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালত স্বীকৃতি দিয়েছে। আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ানোর জন্য আর্মেনিয়ানরা ১০০ বছর ধরে চেষ্টা করেছে। রুয়ান্ডায় যে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিলো সে ব্যাপারে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিলো। তাদের সেই প্রক্রিয়াকে একটি পথ হিসাবে বিবেচনা করে আমরাও এগিয়ে যেতে পারি। জানা যায় জাতিসংঘ ২০১৫ সালে ৯ ডিসেম্বরকে যে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটা পৃথিবীর কোনো গণহত্যার দিনকে বিবেচনা করে নয়। একটি সার্বিক দিক বিবেচনা করেই তা দেয়া হয়েছে৷ সুতরাং কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চ দিয়ে নতুন করে ঘোষণা করার আবেদনও আমরা করতে পারি এবং সে সুযোগটাও নেয়া যেতে পারে। যদি তা করা যায় তা হলে আমাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাসে এটি হবে অনন্য এক মাইলফলক। বিশ্বের নানা দেশের মানুষ যেমন জানতে পারছে ভাষার জন্য আত্মত্যাগের কাহিনি, তেমনি জানতে পারবে কী বর্বর হত্যাকাণ্ডই না ঘটেছিল ২৫ শে মার্চেরকালরাত্রিতে। বাঙালি হিসাবে আমাদের আত্মত্যাগের বীরত্বগাথা বিশ্বে আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। তবে কাজটি এত সহজ নয়, কারণ স্বাধীনতার দীর্ঘ একটা সময় আমরা পেরিয়ে এসেছি। আর আমাদের মাথায় রাখতে হবে পাকিস্তানতো আছেই, পাশাপাশি চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কয়েকটি বড় বড় দেশ আমাদের গণহত্যাকে তারা গণহত্যা বলে মনে করে না। এদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। সরকারের যে উদ্যোগ সেটা যত জোরদার এবং দ্রুত হয় সেটাই হবে সকলের জন্য কল্যাণকর।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ।