দুটি কথা এই মুহূর্তে আমার খুব বেশি মনে পড়ছে। একটি বলেছিলেন এম মোরশেদ খান। তখন বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এবং মোরশেদ খান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সম্ভবত ২০০২ বা ২০০৩ সাল হবে। ইসলামি সম্মেলন সংস্থার ( ওআইসি) মহাসচিব পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করছিলেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে চৌধুরীর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। সেদিন মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওআইসি মহাসচিব পদে বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ইতিবাচক ফলাফলের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা রাখছে?
জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছিলেন, ওআইসিকে সবাই বলে ‘ওহ আই সি’। ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ওআইসি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল তার কিছুই করতে পারছে না। তারা শুধু দেখি – দেখছি কী করা যায় টাইপের বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েই কাজ সারছে।
অন্য যে কথাটি সেটি মালয়েশিয়ার নাগরিক, সিঙ্গাপুরী বংশোদ্ভূত চাইনিজ মি লী‘র। প্রায় ৪১ বছর আগে জর্ডানের বন্দরনগরী আকাবায় আমরা সহকর্মী ছিলাম। কাজের ফাঁকে বা নাস্তার টেবিলে আমাদের বিশ্ব রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে আলাপ হত। অনেক ফিলিস্তিনি আমাদের সহকর্মী ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে ইসরাইলের হাতে ফিলিস্তিনিদের ক্রমাগত মার খেয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই লী বলেছিলেন, ‘অল আরব আর ন্যাটো’। ন্যাটোর ব্যাখ্যা তিনি করেছিলেন এভাবে ‘নট অ্যাকশন, টকিং অনলি’।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতারে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েই হামলাটি হয়। এই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের অন্য আরব রাষ্ট্রসমূহও ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় এই ভেবে যে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের এই যদি হয় নমুনা তাহলে তাদের কী দশা হবে। ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে গত ১৫ সেপ্টেম্বর কাতারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আরব লীগ এবং ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)’র সদস্য রাষ্ট্রসমূহের জরুরি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। কাতারে ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত এই জরুরি সম্মেলনে ইউরোপের ন্যাটোর আদলে একটি আরব সামরিক জোট গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। বিষয়টি জানার পর এ লেখা লিখতে বসে উপরের কথাগুলো মনে পড়ে গেল।
সম্মেলনে ন্যাটোর আদলে আরবদের জোট গঠনে ঐকমত্য হলেও তা কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, কারা কিভাবে করবে তার কিছুই ঠিক হয়নি। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার সিদ্ধান্ত হয়েছে, কিন্তু বাঁধবে কে? আরব রাষ্ট্রসমূহতো শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দিয়ে আছে।
কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরাইল হামলা চালানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত করেছে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের সায় ছিল তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পেয়েছে। দোহার যে স্থানে হামলা হয়েছে তার অনতিদূরে আল উদেইদে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি। যেখানে ১০ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো রাষ্ট্রে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি। এরমধ্যে কাতারের আল উদেইদ ঘাঁটি বৃহত্তম ঘাঁটিগুলোর একটি। ২৪ হেক্টর আয়তনের বিশাল এলাকাজুড়ে এই সামরিক ঘাঁটির অবস্থান। মিশর থেকে কাজাখস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় তাদের যুক্তরাষ্ট্র সামরিক তৎপরতা পরিচালনা করে এই ঘাঁটি থেকে। কাতার ছাড়াও আরব দেশসমূহের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমীরাত, বাহরাইন, কুয়েত, সৌদী আরব, ইরাক, জর্ডান ও মিশরেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সবমিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ঘাঁটিসমূহে যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ হাজার সৈন্য রয়েছে। ফলে ইসরাইলি হামলার পরও তা নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানোর মত হিম্মত কাতার দেখাতে পারেনি। ইরানে ইসরাইলী হামলার পর যেভাবে ইরান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইসরাইলে এবং যুক্তরাষ্ট্রে পাল্টা হামলার মাধ্যমে জবাব দিয়েছিল সে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানোর মানসিক জোর এবং নৈতিক অবস্থান কোনোটাই কাতারের নেই। অন্য আরব দেশগুলিও যদি এভাবে ইসরাইলি হামলার শিকার হয় তাহলে তারাও শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। কারণ তাদের হাত–পা সব যে বাঁধা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং ভূরাজনৈতিকভাবে অতি সংবেদনশীল অঞ্চল হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। দশকের পর দশক ধরে এই আরবরা মার খেয়ে আসছে ইসরাইলের কাছে। অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আরবরা আর কিছুই করতে পারেনি। ফিলিস্তিনের গাজাকে আজ মৃত্যপুরীতে পরিণত করা হয়েছে। নির্বিচারে গণহত্যা চলছে। ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করার পর পুরো গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বসতি স্থাপনের ঘোষণার পরও আরব রাষ্ট্রসমূহের কোনো ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া নেই। জাতিসংঘে গাজায় যুদ্ধবিরতির সর্বশেষ প্রস্তাবে ফের ভেটো দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করেছে ইসরাইলি গণহত্যায় তাদের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে।
সবগুলো আরব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের করদ রাজ্যের মত হয়ে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুদিন আগে মধ্যপ্রাচ্য সফর করে গেছেন। এই সফরে সৌদী আরব, কাতারের সাথে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম কিনে শুধু প্রদর্শন করা ছাড়া আর কী করবে। তাছাড়া যে পরিমাণ অস্ত্র সংগ্রহ করার কথা তা কার কাছ থেকে নেবে? ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে এমন বিধ্বংসী অস্ত্র কী যুক্তরাষ্ট্র দেবে?
কাতারে হামলা হল, তারা একটা গুলি বা মিসাইল ছুড়েও জবাব দিতে পারেনি, পারবেও না যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া। তাহলে কোন ভরসায় তারা ন্যাটোর মত সামরিক জোট গঠনে ঐকমত্যে পৌঁছাল। তারা কী এক হয়ে কখনো ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে? যেভাবে আরবরাষ্ট্রসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের পদতলে নিজেদের সমর্পিত করেছে তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিপক্ষে যায় এমন কোনো পদক্ষেপই তারা গ্রহণ করতে পারবে না।
কাতারের রাজধানী দোহায় ৯ সেপ্টেম্বর হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনের গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার অবস্থান লক্ষ্য করে চালানো এই হামলা ব্যর্থ হলেও এতে ৬ জন নিহত হয়েছেন। আরব সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, হামলার আগে নেতারা নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলেন। যাবার আগে তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনগুলো রেখে যান। ইসরাইল হামলা চালায় নেতাদের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সহসভাপতি খলিল আল খায়া ছিলেন মূল লক্ষ্য। তাঁরা যেখানে অবস্থান করছিলেন তার মূল ভবন ছিল টার্গেট। তবে সেই সময় তাঁরা বাইরে অবস্থান করায় বেঁচে যান।
যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে হামাসের শীর্ষ নেতারা কাতারে বসবাস করে আসছেন ২০১২ সাল থেকে। গাজা উপত্যকায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধে মধ্যস্থতাকারী তিনটি দেশের মধ্যে কাতার অন্যতম। অন্য দুই দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও মিশর।
২০২৫ সালের ১৩ জুন ইসরায়েল হামলা চালায় ইরানে। সে হামলায় নিহত হন হামাসের রাজনৈতিক শাখার শীর্ষ নির্বাহী ইসমাইল হানিয়া। আগের বছর গাজায় নিহত হন তার উত্তরসূরী ইয়াহিয়া সিনওয়ার। হানিয়া ও সিনওয়ারের পর খলিল আয়া আসেন হামাসের শীর্ষ নেতার পদে।
১৫ সেপ্টেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত হয় আরব–ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলন। এতে অংশ নেয় আরব লীগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা। কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল সানীর সভাপতিত্বে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেন আরব রাষ্ট্রসমূহ এবং ওআইসিভূক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান বা প্রতিনিধিরা। এতে কাতারের আমির বলেন, আলোচনায় বসা কাউকে যখন কেউ হত্যা করতে চায় – তখন বুঝতে হবে, এখানে আলোচনার আর কিছুই নেই। হামলাকারীর উদ্দেশ্যই হলো যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে ব্যাহত করা।
বৈঠক শেষে এক বিবৃতিতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সব দেশ কাতারের পাশে আছে।
সম্মেলনে ৬০ টি দেশের নেতারা অংশ নেন। তাদের মধ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিশা আল–সুদানি, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবুল ফাত্তাহ আল–সিসি, পাকিস্তানের উপপ্রধামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশহাক দার উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনে ন্যাটোর আদলে আরব, সামরিক জোটের একটি রূপরেখা তুলে ধরে মিশর। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তারা এই জোটে ২০ হাজার সৈন্য এবং চারতারকা মর্যাদার কর্মকর্তাকে কমান্ডে নিয়োগ দিতে পারে বলে জানিয়েছে। জোটে সৌদি আরবকে মূল সহযোগী হিসেবে গন্য করা হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা চললেও তা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তাও দেখার বিষয়। প্রস্তাবিত জোটের অস্ত্রভাণ্ডার গড়তে চীন থেকে অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়টি আলোচনায় এলেও তা সম্ভব হবে কিনা সন্দিহান অনেকেই। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে গঠিত হল ‘নট অ্যাকশন, টকিং অনলি’ টাইপের ন্যাটো আদলের আরব জোট – এমনটাই যেন না হয়।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।