নৌ পরিবহন সেক্টরে নতুন সংকট

ডব্লিউটিসির দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন না করলে একই সিরিয়ালে যাবে না আইভোয়াক ।। সাড়ে ৬শ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য আজগুবি তথ্য দিয়ে চিঠি, দাবি ডব্লিউটিসির ।। আজ আবার জরুরি বৈঠক

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ৩০ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:২১ পূর্বাহ্ণ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরের সংকট ঘোচানোর আশায় নেয়া সরকারি উদ্যোগ নতুন করে সংকটে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের ‘দুর্নীতি এবং অনিয়মের’ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া এবং চলমান ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ড’ বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (আইভোয়াক) একই প্ল্যাটফরম থেকে একই সিরিয়ালে জাহাজ পরিচালনা করবে না বলে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে পত্র দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। একইসাথে আইভোয়াক মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তাদের জাহাজ তাদের মতো করে পরিচালনার ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়েছে। অপরদিকে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) পক্ষ থেকে আইভোয়াকের চিঠি প্রদানকে হঠকারী পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করে বলেছে, জাহাজ মালিকদের সাড়ে ছয়শ’ কোটিরও বেশি টাকা আত্মসাৎ করতেই তারা সরকারি উদ্যোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নতুন নতুন সংকট তৈরি করছে। এদিকে সার্বিক বিষয় নিয়ে আজ (মঙ্গলবার) বেলা ১২টায় ঢাকাস্থ নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জরুরি বৈঠক ডেকেছেন।

প্রসঙ্গত, নৌপথে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের বিরোধ চলছে গত বেশ কিছুদিন ধরে। জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন তথা বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) সমন্বয়ে গঠিত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে পণ্য পরিবহনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে আসছিল। বেশ কিছুদিন ধরে জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের মাঝে বিরোধ চলে আসছে। এর মধ্যে ডব্লিউটিসিতে চলাচলকারী বিভিন্ন জাহাজ মালিকের সাড়ে ৬শ’ কোটিরও বেশি টাকা আটকে রাখার অভিযোগ এনে অবিলম্বে টাকা পরিশোধের চাপ দিয়ে কিছু জাহাজ মালিক ও পণ্যের এজেন্টকে জাহাজ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে ডব্লিউটিসির অভ্যন্তরীণ বিরোধ আরো প্রকট হয়ে ওঠে। এরই জের ধরে আইভোয়াক ডব্লিউটিসি থেকে বের হয়ে নিজেরা আলাদা একটি সেল গঠন এবং জাহাজ পরিচালনা শুরু করে। তিনটি সংগঠন দুইটি আলাদা পক্ষ হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে থাকে। দুইটি সেল থেকে পৃথকভাবে লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ শুরু হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জরুরি বৈঠক করেন।

বৈঠকে বিবদমান দুই গ্রুপই অংশ নেয়। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর চট্টগ্রামস্থ মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) প্রিন্সিপ্যাল অফিসারকে প্রধান করে তিনটি সংগঠনের নেতাদের সমন্বয়ে ‘অভ্যন্তরীণ নৌ পথে মালামাল পরিবহন সংক্রান্ত শৃংখলা ও মনিটরিং কমিটি’ করে দেয়া হয়। বলা হয় যে, ডব্লিউটিসি বা আইভোয়াক নয়, এই কমিটিই জাহাজ বরাদ্দের ব্যাপারটি মনিটরিং করবে এবং দুই মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে গত ২২ জানুয়ারি থেকে পিও এমএমডির কার্যালয় থেকে একই সিরিয়ালে জাহাজ বরাদ্দ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু গত ২২ জানুয়ারি থেকে ডব্লিউটিসি পিও এমএমডির অফিস থেকে জাহাজ বরাদ্দ শুরু করলেও আইভোয়াক তাতে যোগ দেয়নি।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গতকাল আইভোয়াকের পক্ষ থেকে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে একটি পত্র দেয়া হয়। যাতে ডব্লিউটিসির নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বলা হয় এসবের প্রতিবাদে গত ১৯ নভেম্বর আইভোয়াক ডব্লিউটিসি থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীতে ডব্লিউটিসি অবৈধভাবে জাহাজ বরাদ্দ বন্ধ করে দিলে চট্টগ্রাম বন্দর সচল রাখার স্বার্থে আইভোয়াক আলাদাভাবে জাহাজ পরিচালনা করে। ইতোমধ্যে আইভোয়াক হতে ৯২৯ টি জাহাজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যা প্রকারান্তরে চট্টগ্রাম বন্দর সচল রাখতে সহায়তা করেছে।

চিঠিতে ডিজি (শিপিং) কে বলা হয় যে, ‘আমরা ডব্লিউটিসির কিছু অসাধু নেতার দুর্নীতির ব্যাপারে আপনাকে অবহিত করেছিলাম। যা আপনি উদঘাটন করবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু অদ্যাবদি কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং ডব্লিউটিসির দুর্নীতি আরো বেড়েছে। ডব্লিউটিসি বিগত ২১ বছরে অন্তত ৪৫০ কোটি টাকা ছাড়পত্র বাবদ আদায় করেছে। এর বাইরে আরো ২৪০ কোটি টাকা ডব্লিউটিসিতে জমা হয়েছে। সবমিলে ৬৯০ কোটি টাকা থেকে ৭০০ কোটি টাকার অধিকাংশই বিভিন্নভাবে লুটপাট করা হয়েছে এবং হচ্ছে। পণ্যের এজেন্ট থেকে আদায়কৃত ডেমারেজ বাবদ ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা নিজেরা আত্মসাত করেছে।

নিমজ্জিত প্রকল্প তহবিলে সংগৃহীত ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকার কোনো হিসাব নাই। বিগত সংসদ নির্বাচনের খরচ বাবদ ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ডব্লিউটিসির সাথে নির্বাচনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আরো নানা অভিযোগ উত্থাপন করে আইভোয়াকের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, আমরা স্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই যে, কোনো অনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করবো না। আপনি যদি ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল তথা বিসিভোয়ার এই সমস্ত দুর্নীতির কর্মকাণ্ডগুলো উদঘাটন না করেন এবং এখনো তারা যে সমস্ত অনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে তা থেকে তাদের বিরত না রাখেন তাহলে আমাদের পক্ষে তাদের সাথে কমন প্লাটফর্মে একই সিরিয়ালে জাহাজ চালানো সম্ভব নয়।’ চিঠিতে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রসঙ্গ এনে আইভোয়াকের সদস্যদের জাহাজ নির্বিঘ্নে পরিচালনার ব্যাপারে ডিজি শিপিং এর সহায়তা কামনা করা হয়েছে।

আইভোয়াকের এই চিঠি গতকাল অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি নিয়ে ডব্লিউটিসির নেতা মোহাম্মদ নুরুল হক বলেছেন, সরকারি একটি উদ্যোগ ভেস্তে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু থেকে চলছে। তারা মূলত সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা আত্মসাতের যে নীলনকশা করেছে সেটিই বাস্তবায়ন করতে একই সিরিয়ালে আসতে চাচ্ছে না। বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করে মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ডিজি (শিপিং) পিও এমএমডির নেতৃত্বে যে কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল থেকে আমরা গত ২২ জানুয়ারি থেকে কাজ করছি। অথচ তারা একদিনের জন্যও সরকারি এই উদ্যোগে সামিল হয়নি। ডব্লিউটিসির নামে কল্পিত সব অভিযোগ করে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করে মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, গত ২১ বছর ধরে তারাই তো ডব্লিউটিসিতে ছিলেন। এতোদিন কি হয়েছে তার জবাব তো বর্তমান কমিটি দিতে পারবে না। আমরা বর্তমান যে কমিটি ডব্লিউটিসিতে রয়েছি আমাদের কাছে সব হিসেব রয়েছে। খ্যাতনামা অডিট ফার্ম দিয়ে প্রতিবছরই আমাদের হিসেব অডিট করানো হয়। তাদের কাছে যে আমাদের পাওনা আটকে আছে সেই হিসেবও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমাদের কাছে রয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশ ও জাতির স্বার্থে লাইটারেজ জাহাজ চলাচলের বিশৃংখলা ঠেকানোর জন্য সরকার যা পদক্ষেপ নেবে তার সাথে আমরা সবসময় ঐক্যবদ্ধ বলেও উল্লেখ করেন।

আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা একটি চিঠি দিয়েছি। আমাদের দাবি দাওয়া সেখানে উল্লেখ করেছি। দাবিগুলো যথাযথভাবে পূরণ করে এই সেক্টরটাকে দুর্নীতিমুক্ত করার ব্যাপারে আমরা সরকারের সহায়তা চেয়েছি।

বিষয়টি নিয়ে গতরাতে নৌ বাণিজ্য দপ্তরের মূখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, একটি চিঠি পেয়েছি। তবে এটি নিয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। মঙ্গলবার (আজ) ঢাকায় ডিজি (শিপিং) জরুরি মিটিং ডেকেছেন। মিটিংয়ে পুরো ব্যাপারটি আলোচনা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন
পরবর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিনে ১৩ রিসোর্ট মালিকের বিরুদ্ধে মামলা