নৈর্ঋত

দীপক বড়ুয়া | শনিবার , ৯ জুলাই, ২০২২ at ৮:৩০ পূর্বাহ্ণ

অনন্ত বাবার পাশে বসে টিভি দেখছে।
অনন্তের ভারতীয় বাংলা চ্যানেল পছন্দের নয়। যত্তসব আজেবাজে সংসার ভাঙন কাহিনি।
অবিচল অনন্তের বাবা। একমাত্র সন্তান অনন্ত। ওরা বাবা- ছেলে হোক, বন্ধুর মতই। বাবা মনে মনে বলে, অনন্ত আমার ছেলে, তবে একজন প্রিয় কাছের বন্ধুও বটে। সুখ দু:খের কথা আলোচনা হয় দু’জনে। পছন্দ অপন্দের বিষয়ে কথা বলে।
এ ব্যাপারে কথা উঠলে অনন্ত বলে অন্য কথা।
অনন্ত বলে,- বাবা আপনার সাথে আমি একমত নই। আমার সব কথা কখনও আপনাকে শেয়ার করিনি। অনেক কথা আছে, শেয়ার করা যায় না।
অনন্তের কথাগুলো অবিচল মনের ভেতর শেয়ার করে। মন উত্তর দেয়, পৃথিবীতে কেউ, এমন কি স্বামী স্ত্রীও নিজের গোপনীয় অনেক কথা বলে না। বলা যায় না। বললে বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠবে। সংসারে আগুন জ্বলবে। তাই বলা হয় না। এটাই সংসার নিয়ম। সবাই মেনে চলতে বাধ্য।
টিভিতে কৃঞ্চকলি সিরিয়াল দেখছে অবিচল, পরপর সব সিরিয়াল দেখবে রাত বারটা পর্যন্ত। অনন্ত প্রশ্ন করে,
-বাবা, এসব সিরিয়ালে শিক্ষনীয় কিছু আছে? হিন্দী, ইংরেজি, ডিসকভারি সিরিয়াল দেখবেন। কত জানার বিষয় আছে!
-বাবার বয়স হলো, এসব দেখে সময় কাটাই, এই আরকি। ঐসব ইংরেজি, হিন্দী বুঝি না বাবা। ভালো লাগে না মোটে।
অবিচল সাদাসিধে মানুষ। অতি সাধারণ একজন। এক সময় সরকারি চাকরী করতেন। এখন অবসর জীবন। সময় কাটে তুতুল, পুতুলকে নিয়ে। অনন্তের মেয়ে ওরা। তুতুল ইশকুলে যায়।
অনন্ত প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করে। ভালো বেতন পায়। ওর মাসিক বেতনে বাসাভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সংসারের যাবতীয় খরচ চলে।
বাড়তি আয় অবিচলের মাসিক পেনশন। টানাটানির সংসার। এরপরও ওরা স্বপ্ন দেখে। দূরে যাবার কথা ভাবে। সেজন্য ওরা সংসারের খরচ থেকে মাসিক টাকা সঞ্চয় করে।
প্রতিবছর বেড়াতে চায় অনন্ত। তবে একা নয়। পরিবারের সবাই। কী অদ্ভুত অনন্ত। স্বামী-স্ত্রী বিয়ের পর হানিমুনে যায়। সেখানেও অনন্ত মা-বাবা ছাড়া যায়নি। একা বেড়াতে অনন্তের ভালো লাগো না। কেমন যেন পূর্ণতা থাকে না। সে মা- বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। মা- বাবাকে নিয়ে ভাবে।
মা কতবার বলেছে, -বিদেশে যাবার চেষ্টা কর।
অনন্ত উত্তর দেয়,
-তা হয় না মা। তোমাদের ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। তাছাড়া, তোমাদের বয়স বাড়ছে। দেখভাল করবে কে শুনি।
মা বলে,
-সেই নিয়ে তুই ভাবিসনে, বুদ্ধ আছেন। তিনি রক্ষা করবেন।
এবারো বেড়াতে যেতে চায় অনন্ত।
বাড়তি টাকার অভাবে পারে না। কখনও কোনো মাসে আজগুবি খরচ আসে। মানুষ সবসময় নিয়ম মেপে চলতে পারে না। নিয়ম ভেঙে যায় হঠাৎ।
তুতুলের মাসিক বেতন আট হাজার টাকা। ইংলিশ ইশকুলে পড়ে। এতে বাবার ইচ্ছে ছিলো না। বাবা বারবার বলেছে, প্রতিমাসে বেতন দিতে পারবেতো! পরে যদি সমস্যা হয়? ইশকুল ছাড়তে হবে তখন।
অনন্ত উত্তর দেয়,- বাবা, তুতুলের প্রাইমারিটা শক্ত না হলে উপরের ক্লাসে কষ্ট হবে। তাছাড়া আজকাল ইংরেজিতে ভালো না হলে চলে না। বিশেষ করে দেশের বাইরে পা রাখলে ইংরেজি ছাড়া চলে না।
অবিচল মনেমনে বলে, এটা অনন্ত ঠিক বলেছে। বিদেশে গেলাম অনেকবার। বোবার মত বসে থেকেছি। না জানি ইংরেজি, না জানি থাই, জাপানি ভাষা।
অবিচল সোজা অনন্তকে বলে,
-অনন্ত, প্রতিটি জিনিষের দাম থরথর করে বাড়ছে। পিঁয়াজের খেলা দেখলাম, পঁচিশ থেকে দু’শ টাকা। নামতেই চায় না। কিছুটা নামে, আবার সগৌরবে উঠে। সাথে সাথে বাসা ভাড়া, ওয়াসা, গ্যাস, বিদ্যুত, ট্যাক্স সবকিছুর দাম বাড়ছে হুহু করে।
– বাবা, মানুষের মাথাপিছু আয়ও তেমন বেড়েছে। দেশের মানুষ ক’জন ট্যাক্স দেয়! আর আমাদের দেশের মানুষেরা উপযুক্ত ট্যাক্স দেয় না। একটা দেশের আয়তো মানুষের ট্যাক্স। সরকারের আয়তো জনগণের আয়ের উপর। আমরা এত সুখসুবিধা ভোগ করছি, সবতো সরকারে দিচ্ছে। দেখেননা আমেরিকা, বৃটেন, জাপান সহ সকল বিদেশে দেশের জনগণের ট্যাক্সে দেশের উন্নতির করছে। শুধু আমাদের দেশ পারে না বাবা। কারণ আমরা কেউ দেশপ্রেমী নই।
অনন্তের কথার পরে অবিচল বলে,
– বাবা, মধ্যবিত্তরা সবাই ট্যাক্স দেয়। ওরা ট্যাক্স না দিলে ভয় পায়। ট্যাক্স দিচ্ছে না বিত্তবান, মন্ত্রী, নেতারা। ওদের ট্যাক্স দিতে ভয়, আগ্রহ দু’টিই নেই। ওরা রীতিমত ট্যাক্স প্রদান করলে দেশ আজ অনেক দূর এগুতো।
– বাবা, শুনেছি ১৯৭৪ সালে এক কেজি শুকনো মরিচ একশত ষাট টাকা, চাল এক কেজি দশ টাকা হওয়ায় অনেক লোক মারা গেছে। অথচ এখন তরকারি এক কেজি ষাট টাকার উপরে। অন্যকিছুর দামতো আরো বেশি। কই মানুষতো মরছে না।
– ঐ যে তুমি বললে মানুষের আয় বেড়েছে। তাছাড়াও মানুষ আজকাল অনেক সচেতন। কী শরীর, কী খাওয়া-দাওয়া! ভেবে সব করছে। করে কেউ ভাবে না।
মানুষের গড় আয়ও বেড়েছে ঠিক। আজকাল একজন রিকসা চালক, একজন সিএনজির চালক মাসে ত্রিশ চল্লিশ হাজার আয় করে। তাদের ছেলে মেয়ে কম। তারাও সংসার বড়ো করতে চায় না। ওরা যথেষ্ট সচেতন। তাদের সন্তানদের ভালো ইশকুলে পড়াতে সাহস করে। আর একজন ছাত্র এম বিএ পাশ করে অত টাকা আয় করতে পারে না। একটা বিরাট ব্যবধান।
– বাবা, আরেকটা জিনিষ দেখেছেন, মোবাইল ফোনের টাকা বেশি বেশি কাটছে। এই ভরলাম এই শেষ।
-আমরা সামান্য কিছু নিয়ে ভাবি না। অথচ কত টাকা মোবাইলে প্রতিদিন ভরছি হিসাব রাখি কেউ? ওটা এখন বড় ধরণের সৌখিন একটা বিষয়। আজকাল রাস্তায় মোবাইল হাতে ছাড়া কোনো লোক দেখা যায় না। কী ছেলে মেয়ে, কী রিকশা চালক, কী ভ্যানচালক, কী সবজি বিক্রেতা! আবার একজনের কাছে শুধু একটি মোবাইল নয়, তিন চারটা থাকে। আমরা ফোনে ফালতু কথাই বেশি বলি। কম কথা বলতে জানি না কেউ। ছোট একটি কথা বারবার বলে শেষ করি। মোবাইল হলো দরকারি কথাটি সংক্ষেপে বলা। এখন মোবাইলে মিথ্যেটা বেশি বলছি সবাই।
– যেমন?
– ধরো, আমি সিনেমা হলে, বলছি অফিসে কাজের প্রচণ্ড চাপ। এরকম শতশত মিথ্যে বলে যাচ্ছি ফোনে। এসবতো অনর্থক। আগে মোবাইল ছিলো না, এতো মিথ্যাও বলতে হতো না।
একদিন সবাই রাঙামাটি যায়।
কী অদ্ভুত ছেলে অনন্ত। একটি মাইক্রো ভাড়া করে তিন দিনের জন্য।
মোটেলে থাকবে। বনভন্তের মন্দিরে সংঘদান করবে। ঘুরবে, খাবে।
অবিচলের প্রচণ্ড রাগ হয়, অহেতুক খরচের জন্য। অনন্তকে বলে,
– তিন দিন থাকার প্রয়োজন কী? সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরলে হয় না!
– বাবা, বছরে এক বারই বেড়ানো। ক্ষতিটা কী? সবাই এক সঙ্গে আনন্দ মজা দু’টোই করলাম। তুতুল, পুতুলের ভালো লাগবে।
অবিচল কথা বাড়ায় না।
ভিক্ষুসংঘের সংঘদানের বাজার করছে অনন্ত। সীমাহীন। অনন্তের মা বললো,-অত খরচের দরকার কী?
– মা, দান করার সময় মন পরিষ্কার রাখতে হয়। না হয় দান হয় না।
একদিন দুপুরে অনন্ত বাবার ঘরে যায়।
বাসায় কেউ নেই। বাইরে গেছে। অবিচল টিভি দেখছে। বাদাম খাচ্ছে।
হঠাৎ অনন্তকে দেখে বাবা প্রশ্ন করে,
– বাবা, কিছু বলবে?
– হ্যাঁ বাবা, একটি কথা বলতে এলাম।
– তার আগে আমার একটি কথার উত্তর দাও তো! সবসময় ভাবি, উত্তর খুঁজে পাই না। আমরা সবাই এই সুন্দর পৃথিবীতে আছি। পৃথিবী থেকে চাঁদকে দেখছি, কী সুন্দর চাঁদ। মানুষ আবার চাঁদে যাচ্ছে। চাঁদ থেকে এই পৃথিবী দেখছে, বলে, ভারি মিষ্টি এই পৃথিবী। শুনেছি পৃথিবী থেকে সূর্য তের লক্ষগুণ বড়ো। চাঁদ-সূর্যের পরও দেখি আকাশ কতো বড়ো। আচ্ছা বাবা, আকাশ চাঁদ সূর্য থেকে কতটা বড়ো?
অনন্ত নিজেও জানে না কতো বড়ো।
ভাবে। অনেকক্ষণ ভেবে বলে,
– বাবা, আকাশতো অসীম। তার কোনো সীমারেখা নেই। সেটা সঠিকভাবে আমি বলতে পারবো না। তো আমি যেই কথাটি বলতে এলাম, তা শুনুন।
– কী কথা বাবা! তোমাকে খুবই বিষণ্ন দেখাচ্ছে। বলো। কী কথা!
অনন্ত বলতে শুরু করে থেমে যায়। লজ্জায় বলতে পারে না প্রথমে। মনে সাহস বাড়িয়ে বলতে শুরু করে।
– বাবা, একটা কথা শেয়ার করবো। আমার মাথায় হাত রেখে কথা দেবে, কাউকে বলবে না। এমনকি মাকেও না।
অবিচল কোনো দিনও এই পরিস্থিতিতে পড়েনি। নিজেই ভাবে, কী অমন কথা অনন্তের, কাউকে বলা যাবে না। না না, ছেলে নিশ্চয়ই বিপদে পড়েছে। ধৈর্যসহ বলে,
-কী কথা অনন্ত বলো। মাথায় হাত রেখে অবিচল বলে, কাউকে বলবো না বাবা।
মুখ খুলে আবার বন্ধ করে অনন্ত। ভয়ে লজ্জায় বলতে থেমে যায়।
অবিচল অনন্তের কাণ্ড দেখে বলে,
-অনন্ত, তুমি নিঃসংকোচে বলো মনের কথা। বাবা কিছুই মনে করবো না।
– বাবা, আপনার বৌমা আবারও প্রেগনেট।
– সেতো আনন্দের কথা।
– আপনার বউমা রাগ করেছে।
– তাতে রাগ করার কী আছে?
-জানেন বাবা, ঐ খুশিতে আমি একটি নামও ঠিক করেছি। মেয়ে, ছেলে যা হোক, নাম হবে নৈর্ঋত। কিন্তু আপনার বউমা বলেছে, তোমার আয় আছে? এই দু’টোর খরচ কুলোতে পারছো না, ওরা বড়ো হচ্ছে। পুতুলকে সামনে ইশকুলে দিতে হবে। দিনদিন খরচ বাড়ছে। এরপরও আবার আরো একটি সন্তান চাইছো কোন সাহসে?
– কী চাও তুমি?
– এবরশন করাতে চাই।
– একটি জীবন নষ্ট করতে চাও?
– হ্যাঁ, চাই।
– না না, তুমি জানো না প্রাণী হত্যা মহাপাপ। জেনে শুনে কেন একটি জীবন নষ্ট করবে?
– জানি, উপায়তো নেই। কঠিন সত্যকে মেনে নিতেই হয়।
– কোনো উপায় নেই!
– না, কারণ তোমার অপ্রতুল্য আয়।
– এরপরও আমি একটি জীবন শেষ করতে চাই না স্নিগ্ধা।
– তা’ হলে আমি কী করবো?
– আমাকে ক’টা দিন ভাবতে দাও।
– ঠিক আছে, তবে বেশি দিন নয়। এখন পাঁচমাস চলছে। না হয়
মা- বাবার অজানা থাকবে না।
অনন্ত বাবাকে বলে,
-বাবা, এই কথাটি আপনাকে বললাম। এখন আমি কী করতে পারি।
– তোমারতো দু’টো ছেলে, একটি মেয়ে যদি আসে, সেতো ভালো কথা, আনন্দের।
– বাবা, যদি ছেলে আসে? আমরাতো এখনও কেউ জানি না ছেলে না মেয়ে?
অবিচল ভাবনায় পরে।
তাঁর একটি নাতনির সখ অনেক দিনের। একটি পরিবারে একজন মেয়ের কতটা প্রয়োজন। মেয়েরা ভাগ্যবতি, লক্ষী। একটি মেয়ের ছোঁয়ায়তো সংসার চকচক করে। যদি সে মেয়ে হয়, এবং মেয়ে হয়ে সে পৃথিবীতে আসতে চায়, ক্ষতি কী?
অনন্ত আবারও বলে,
– বাবা, কিছু ভাবছেন? কিছু বলবেন, আমি কী করবো?
বাবা চুপ।
পরপর তিনবার অনন্ত বাবার কাছে একই প্রশ্ন করে।
বাবা অনন্তের কথার উত্তর দেয় না।
সেখান থেকে শোবার ঘরে চলে যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটেকনাফে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ আটক ১
পরবর্তী নিবন্ধপবিত্র ঈদুল আযহার তাৎপর্য