রহমান সাহেব শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বেশ ক’বছর আগে। মিতব্যয়ী জীবনযাপনের সুবাদে অনেক আগেই নিজের একটা বাড়ি বানিয়ে নিয়েছিলেন শহরতলীতে। ছেলেমেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে বিদেশে। একমাত্র ছোটটি আছে বুড়ো বাবা মায়ের সঙ্গী হয়ে। সুলতানা বেগমকে নিয়ে অর্ধ শতকের দাম্পত্য তাঁর।
চোখের সামনে নতুন নতুন ঘরবাড়ী ওঠে ও–বাড়ীর এপাশে ওপাশে। পশ্চিমের জানালা বন্ধ হয়েছে, দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে আগের মতো আলো হাওয়া খেলেনা। এখনও পূর্ব দিক খোলা। সকালের সূর্যোদয় ঘরে বসেই দেখতে পান সুলতানা। কিন্তু বেলা চড়তেই শুরু হয়ে যায় শব্দের মেলা; নির্মাণাধীন বাড়ী থেকে ইট ভাঙা যন্ত্রের গগনবিদারী শব্দ, টাইলস কাটার শব্দ– আরও কত রকমের অচেনা শব্দ। পুবের জানালা বন্ধ হতে খুব বেশী দেরি নেই।
সুলতানা বেগমের একমাত্র বিলাসিতা পড়ন্ত দুপুরের ভাতঘুম। হাতে ধরা খবরের কাগজ কিংবা রোকেয়া, শরৎ, হুমায়ুনদের বালিশের একপাশে আলতো করে সরিয়ে রেখে যেইনা চোখ দুটো বুজতে যাবেন, তখনই চেনা অচেনা শব্দের তোড়ে ভেস্তে যায় অনেক আয়োজনের দিবানিদ্রা। তবুও ভাল রাতে তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে যান। ঘুম ভাল না হলে শরীরে বল পাননা। এবারে রাতের ঘুম কেড়ে নেবার সব বন্দোবস্ত পাকা। রাতভর চলে অনুষ্ঠান– কখনও গানের জলসা, কখনওবা ওয়াজ মেহফিল। চারদিকে এত এত শব্দের উৎপাত দিনরাত! আজকাল পৃথিবীর নানান শহরে ছড়িয়ে থাকা ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কথাও বলতে পারেন না তাঁরা ভাল করে। ওদের সুবাদে দেশভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁরা বার কয়েক। পৃথিবীর কোন দেশেই বিনোদনের নামে এমন উন্মাদনা দেখেননি। সংগীত যতই শ্রুতিমধুর হোক না কেন, ওয়াজ মাহফিলে যতই পুণ্য সঞ্চয় হোক না কেন, নাগরিকের শান্তি ভঙ্গ করে, কাজের আর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে এমনকি একান্ত প্রার্থনার সুযোগও নষ্ট করে দিয়ে এ কেমন উন্মত্ততা চলে আমাদের দেশে বছর ব্যাপি! কেউ যেন দেখার নেই, কারও কিছু বলার নেই।
একবার পেশাদার শিল্পী আনা হয়, বড় বড় শব্দযন্ত্র ভাড়া করা হয়। সীমানা প্রাচীরের ওপাশটাতেই সামিয়ানা খাটানো হয়। শব্দতরঙ্গে রহমান সুলতানার মাথা ভারী হয়ে ওঠে। বুক ধুঁকধুঁক করে অচেতন হবার উপক্রম হয়। মধ্যরাতেও থামার লক্ষণটি নেই। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি বাস করেন কয়েক বাড়ি পরে। রহমান সাহেব তাঁর শরণাপন্ন হন; রাতের জলসা বন্ধ করার ব্যাপারে একটা কিছু করার জন্য অনুরোধ জানান। জনপ্রতিনিধি হেসে কুল পাননা– ‘ছেলেমেয়েরা পিকনিক করছে, রাত জেগে গানবাজনা না করলে জমেনা যে। একটু কষ্ট করেননা মাস্টার সাব’।
শব্দতরঙ্গ চলতে থাকে বিরতিহীন। সূর্য ওঠার সময়টাতেই কেবল সুনসান নীরব চারিধার। সুলতানা বড় আয়েশ করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কাগজ পড়েন তখন। রহমান সাহেব হাঁটতে বের হন। নির্মাণ শ্রমিকদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। ওদের মুখে নানা অঞ্চলের ভাষা। বড় মায়া হয় ছেলেগুলোর জন্য। কিন্তু শব্দ বাড়তে শুরু করলে কানে তালা লেগে শরীর গুলিয়ে আসে। বড় অসহায় লাগে। অপেক্ষায় থাকেন সুলতানা। কিন্তু এক বাড়ীর কাজ শেষ না হতেই শুরু হয়ে যায় আরেক বাড়ীর কাজ। আবার ইট বোঝাই, বালু বোঝাই, রড সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকের ঘরঘর। সব এখন চেনা শব্দ।
নৈঃশব্দের প্রতিক্ষায় সুলতানা–রহমান। অনেক দিন পর এক সকালে হঠাৎ থমকে যায় পৃথিবী। অদৃশ্য এক জীবাণু উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে পৃথিবীময়। চীন দেশ থেকে আমেরিকা ইউরোপ হয়ে ভূমধ্যসাগর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া অভিমুখে রওনা করে নিঃশব্দ জীবাণু কোভিড–১৯। পথিমধ্যে মৃত্যুউপত্যকায় পরিণত হয় হাজারও জনপদ। আলো ঝলমলে শহর বন্দর পরিণত হয় ভৌতিক রাজধানীতে, অতিপ্রাকৃতিক ঘটনানির্ভর চলচ্চিত্রে যেমনটা দেখানো হত এতকাল।
সেই জীবাণু বাংলাদেশে অবতরণ করে মার্চের প্রথম সপ্তাহে। বহু প্রতীক্ষার মুজিববর্ষের সাজসাজ রব থমকে যায়। ভেস্তে যায় বর্ষব্যাপী গৌরবময় স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সকল পরিকল্পনা। সরকারী প্রজ্ঞাপন জারি হয়– কেউ বাইরে বের হবেনা। সব কাজ বন্ধ। ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে দেশজুড়ে।
সুলতানার ঘর উঠোনে এখন রাজ্যের নিস্তব্ধতা। তবে ভৌতিক মনে হয়না চারিধার, কারণ পাখপাখালির কলকাকলি সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাত্রি– একেক সময় একেক পাখি। চেনা পাখিদের মাঝে ভিড় করছে নানা জাতের নাম না–জানা পাখি। ওদের যেন ঈদ লেগেছে। পৃথিবীর বাঁচা মরার এমন দুঃসহ দিনেও পাখিদের উল্লাস দেখে মন ভরে ওঠে ওদের।
মাস তিনেক পর। জীবাণুর ছোবলে মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত অগুনতি। কতজনে কাজ হারিয়ে নিঃস্ব! রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দুর্দশাগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ বরাদ্দ হয় অকাতরে। কিন্তু বিতরণের বেলায় অকাতরে হাত খুলতে বড় বাঁধে আমাদের নামি দামী নাগরিক ও জনপ্রতিনিধিদের। ত্রাণের অর্থ ও চাল ডাল তেল আটা লুটপাট হয়নি– এমন দিন আমাদের বাংলাদেশ কোনদিন দেখেনি। দেখবে কোনকালে– সে আশাও নেই। নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের আর ঘরে থাকা চলে না। অতঃপর খুলে যায় সব বাধা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে নানা প্রজ্ঞাপন জারি হলেও কে শোনে কার কথা! আমরা যে সবাই রাজা! বাংলাদেশ ফিরে এসেছে আবার আগের মেজাজে। জলাভূমি, ফলবতী কৃষিজমি সব চলে যাচ্ছে দালানের পেটে। আমাদের আরও আরও দালান চাই। অতঃপর আবারও ইট বোঝাই, বালু বোঝাই, রড সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকের ঘরঘর। ওয়াজ মাহফিল শুরু হয়েছে সীমিত পরিসরে। বর্ষপঞ্জি অঘ্রাণে পা রাখতে না রাখতে শুরু হয়ে যায় নিশিকালিন গানের জলসাও, তবে হ্যাঁ অবশ্যই সীমিত পরিসরে। রাত্রি আর নিঝুম থাকেনা। সীমিত পরিসরের সীমাহীন ব্যাপ্তি দেখে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সুলতানা রহমান– আমাদের জাতিগত উন্মাদনা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। মৃত্যুভয়ও আমাদের ক্ষণিকের তরে নীরব হতে দেয়না। দিবারাত্রির কোন প্রহরেই আর নেই নৈঃশব্দ্য।
পুনশ্চঃ বছর তিনেক পর। এখন সকলে স্বাধীন, বাধা বন্ধনহীন। যখন খুশি, যেখানে খুশি, যেভাবে খুশি শব্দ তরঙ্গ ছড়িয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে। মঞ্চের ছড়াছড়ি নগর নগরে, গাঁও গেরামেও। অনুষ্ঠানস্থল ছাড়িয়ে কয়েক ক্রোশ দূরে শব্দ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে অত্যাধুনিক শব্দযন্ত্র। দেশের মানুষের ঘুমিয়ে কাজ নেই। রাতভর কেউ নাচগান আবার কেউবা ওয়াজ মাহফিল নিয়ে পড়ে থাক। রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানিয়ে আধুনিকতার স্বাদ পেতে চাওয়ার এই উন্মত্ততার বুঝি শেষ নেই।