একুশে পদক পেয়েছেন আবদুল মালেক। চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান আবদুল মালেক ও প্রাচীনতম দৈনিক আজাদী এক ও অভিন্ন। আজাদীর জন্ম আমরা দেখি নি। আমার বয়স ও আজাদীর বয়স সমান সমান। কাজেই আজাদীর সূচনা লগ্ন দেখি নি আমি। কিন্তু কৈশোরেই জেনে গেছি চট্টগ্রাম আর আজাদী সমার্থক। ছড়া লেখার কালে আগামীদের আসরে দু একবার উঁকি ঝুঁকি মারলেও আমাদের টার্গেট তখন ঢাকার কাগজ। কিন্তু আজাদী ও ছিলো মনে চিন্তায় আর স্বপ্নে জাগরুক। কারণ বাড়ীতে ঢাকার যে কাগজ ই রাখা হোক না কেন চট্টগ্রামের মানুষ আজাদী না পড়ে দিন শুরু করতে পারেন না। পরে যখন বয়স বাড়লো নানা কাজে চটৃগ্রামের বাইরে যেতাম। ভোর সকালে ট্রেনে বা বাসে চেপে চাটগাঁ ফেরা পর পরই হকারের কাছ থেকে কিনে নেয়া আজাদীই ছিলো সকালের মূল প্রাতঃরাশ ।
এই আজাদীর সাথে সখ্যতা তৈরী হলো যৌবনে। কবিতার টালমাটাল জগত পেরিয়ে যখন গদ্য আর কালম লেখার শুরু তখন থেকেই আজাদীর সাথে পথ চলা। প্রয়াত সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এর স্নেহ আর আনুকূল্যে খুলে গিয়েছিল আজাদীর দুয়ার । অবশ্য ই তার নেপথ্যে ছিলে প্রয়াত সাহিত্য সম্পাদক অরুণ দাশগুপ্ত। এঁদের ভালোবাসা আর স্নেহ তখন ছিলো হাতে স্বর্গ পাবার মতো। যৌবনের শেষ প্রান্তে যখন চেনা মানুষদের আবার চিনতে শুরু করেছিলাম যখন বুঝতে পারছিলাম কাঁচা ধারণা আর পাকা অভিজ্ঞতার ফারাক তখন ই আজাদীর সাথে বন্ধুত্ব হয় আমার। সাহিত্য পাতার পাশাপাশি আনন্দন ছোটদের আসর আর বলাবাহুল্য প্রদীপ দেওয়ানজী রাশেদ রউফ সব মিলিয়ে সে এক অন্য বলয় ।
এতো কিছুর ভেতরেও আমরা সবাই জানতাম অগোচরে আরেকজন মানুষ আছেন। যিনি না ধাকলে কিছুই কিছু না। কিন্তু কি আশ্চর্য ! তিনি লাইম লাইটে আসেন না। সবাই জানেন সবাই চেনেন কিন্তু মানুষটি আত্মপ্রচার বিমুখ। তাঁর সাথে বেশ কিছু সামাজিক পারিবারিক ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। সালাম দিয়ে কথাও হয়েছে। সবসময় এক ধরণের পরিমিত আর শান্ত মনোভাব। শাহ আমানত শাহ(র:) এর মাজারের ভক্ত আমি। বংশধরদের একজন ছিলেন আমার ভালো বন্ধু। বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী সে বন্ধুর ওয়ালিমা বিয়ে এসব অনুষ্ঠানে ওদেখা হয়েছে জনাব আবদুল মালেকের সাথে। সর্বত্র এক সামাজিক অতিথি পরায়ন ভদ্রলোক। অথচ তাঁর ভগ্নিপতি তখনকার আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের সত্তর তম জন্ম বার্ষিকীর সভায় ভাষণ শুনে জানলাম কতোটা রসিক আর প্রাণবন্ত মানুষ তিনি।
আমার এখনো মনে আছে তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন মানুষ মানুষকে সাধারণত: মাথার চুলের সমান আয়ু পাবার দোয়া করে থাকে। নিজের উধাও হয়ে যাওয়া চুল দেখিয়ে বলেছিলেন , দুলাভাইকে এই দোয়া ও করা যাচ্ছে না। বলেছিলেন বটে কিন্তু আমরা সবাই জানি তিনি কতোটা স্মার্ট আর কতোটা অভিজাত। চেহারা পোশাক আচরণ ও রুচিতে অভিজাত এই মানুষটি কথা বলেন কম শোনেন বেশী। যেটা আজকের বাংলাদেশে অনুপস্হিত আর যার প্রয়োজন সবচেয়ে অধিক। রাজনীতি সমাজ শিল্প সাহিত্য বা যে কোন অঙ্গনে কথা কম কাজ বেশীর এমন উদাহরণ বিরল।
আসুন তাঁর সম্পর্কে আবার একটু জেনে নেয়া যাখ। একুশে পদকের জন্য মনোনীত এম এ মালেক এ অঞ্চলের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এবং মরহুমা মালেকা খাতুনের একমাত্র পুত্র। ১৯৪০ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি নগরীর আন্দরকিল্লাস’ কোহিনুর মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েটস স্কুল এবং চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে অধ্যয়ন করেন। দৈনিক আজাদী প্রকাশের মাত্র দুই বছর পর ১৯৬২ সালে পিতার মৃত্যু হলে দৈনিক আজাদী প্রকাশনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। তখন থেকেই কখনো সম্পাদক আবার কখনো পরিচালনা সম্পাদক হিসেবে নিরব”িছন্নভাবে দৈনিক আজাদী প্রকাশ করে আসছেন এম এ মালেক। বর্তমানে তিনি দেশের প্রবীণতম সম্পাদক। টানা ৬২ বছর তিনি দৈনিক আজাদীর প্রকাশনার সাথে জড়িত। পত্রিকার সাবেক সম্পাদক, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য, স্বাধীনতা পদকে ভূষিত রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের মৃত্যুর পর ২০০৩ সাল থেকে আজাদীর সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন এম এ মালেক। এর আগে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো সময় তিনি আজাদী সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে জনমত সৃষ্টিতে অনন্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে প্রকাশ হয়েছিল দৈনিক আজাদী। জয় বাংলা-বাংলার জয় ব্যানার শিরোনামে প্রকাশিত ওই পত্রিকার সম্পাদকও তিনি।
এটুকুতেই স্পষ্ট যোগ্য মানুষের স্বীকৃতি মিলেছে এবার। তাঁর সেবা কার্যক্রম ও কি কম? সেবার মন্ত্রে বিশ্বাসী লায়ন এম এ মালেক লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল এর প্রাক্তন গভর্নর, চট্টগ্রাম চক্ষু ইনফার্মারি অ্যান্ড ট্রেনিং কমপ্লেস (সিআইইটিসি) এর চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য ব্লাইন্ড (বিএনএসবি) এর ট্রাস্ট্রি মেম্বার, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রাক্তন পরিচালক, চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেড এবং চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাব লিমিটেডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক বোর্ড মেম্বার, চট্টগ্রাম কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সাবেক চেয়ারম্যান ও লাইফ মেম্বার বাংলাদেশ সংবাদপত্র মালিক সমিতির (নোয়াব) নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বোর্ড সদস্য, পূর্বাঞ্চলীয় সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট, চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবের ভাইস চেয়ারম্যান এবং লাইফ মেম্বার, চট্টগ্রাম বোট ক্লাব লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট, ভাটিয়ারি গল্ফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব লিমিটেডের সদস্য, চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক এসোসিয়েশনের লাইফ মেম্বার, চিটাগাং কমার্স কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সভাপতি, চিটাগাং কলেজিয়েটস স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সভাপতিসহ চট্টগ্রামের অসংখ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। তিনি পিতা মরহুম আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়টি ফ্যাকাল্টিতে দশটি মেধাবৃত্তি প্রদান করছেন গত বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সকল অন্ধ ছাত্র-ছাত্রীর প্রত্যেককেই তিনি মাসিক ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।
এই তথ্যগুলো আমার ও জানা ছিলো না। কারণ তিনি তেমন ধারার মানুষ যিনি নেপথ্যে থেকে কাজ করতে ভালোবাসেন। আর সে নেপথ্যচারী নিজেই বললেন: এটা চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের অর্জন। এ অর্জন আজাদী পরিবারের। আমি বিশেষভাবে স্মরণ করছি আমার মরহুম পিতা এ অঞ্চলের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক এবং আমার মা মালেকা খাতুন এবং স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে। বিশেষভাবে ঋণী আমার স্ত্রী কামরুন মালেকের প্রতি, আমার পরিবারের সদস্যদের প্রতি। দিনের বেশিরভাগ সময়ই আজাদীর জন্য ব্যয় করলেও তারা কোনোদিন কোনো অভিযোগ-অনুযোগ করেনি। অতল ভালোবাসা সবার জন্য।
এম এ মালেক তাঁর এই প্রাপ্তি চট্টগ্রামবাসীকে উৎসর্গ করে বলেন, ‘জীবনের বাকি দিনগুলোও চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের কল্যাণে ব্যয় করে যেতে চাই।’
এরপর আর কথা চলে না। থাকে শ্রদ্ধা আর ভালোলাগার আবেশ। আপনি ভালো থাকবেন। শতায়ু হয়ে আমাদের চট্টগ্রাম ও দেশের মুখ উজ্জ্বলতর করবেন। সিডনি তথা অষ্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। জয়তু আজাদী জয়তু আবদুল মালেক ।
লেখক: সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, কবি ও কলামিস্ট