চার হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে চার লেনে উন্নীত করা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অপরিকল্পিত মেডিয়ান গ্যাপের কারণে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চরম ঝুঁকি নিয়ে এই মহাসড়কে চলাচল করছে। নিত্য দুর্ভোগের পাশাপাশি অসংখ্য মানুষকে পোড়াতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকার বাড়তি জ্বালানিও। অহেতুক নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কিছু মেডিয়ান গ্যাপ তৈরি করে এই দুর্ভোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করার সুযোগ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, বছর কয়েক আগে চার হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কক চার লেনে উন্নীত করা হয়ছে। চট্টগ্রামের সিটি গেট থেকে দাউদকান্দি টোল প্লাজা পর্যন্ত ১৯২.৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়কের প্রায় সাড়ে ১৬ ফুট প্রস্থ একটি ডিভাইডার রয়েছে। বিশাল এই ডিভাইডারটিকে মাঝে রেখে দুইপাশে নির্মাণ করা হয়েছে ৯.৩ মিটার বা সাড়ে ৩০ ফুট প্রস্থ মহাসড়ক। প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজার গাড়ি চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এই রাস্তা চালুর মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত এই মহাসড়কে যান চলাচলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের আশা করা হয়েছিল। চার ঘণ্টায় ঢাকা চট্টগ্রাম যাতায়াতের স্বপ্নও দেখেছিল মানুষ। কিন্তু নানামুখী বিশৃঙ্খলা এবং প্রতিকূলতায় সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। প্রশস্ত করা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একটি অংশ অবৈধ পার্কিং এবং দোকান পাটের দখলে থাকায় যান চলাচলে প্রত্যাশিত গতি আনা সম্ভব হয়নি। তবে এই রাস্তায় বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি করেছে অপরিকল্পিত মিডিয়ান গ্যাপ। রাস্তা জুড়ে বিশাল ডিভাইডার তৈরি করা হলেও রাস্তা পারাপারের গ্যাপগুলো রাখা হয়েছে অপর্যাপ্ত এবং অপরিকল্পিতভাবে।
স্থানীয়রা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুপাশে লাখ লাখ মানুষের বসবাস। স্কুল কলেজ হাট বাজারসহ নানা ধরনের স্থাপনা রয়েছে সড়কের পাশে। এসব স্থাপনায় মানুষকে আসা যাওয়া করতে হয়। নানা প্রয়োজনে মানুষকে রাস্তা পারাপার করতে হয়। ব্যক্তিগত গাড়ি, পণ্য পরিবহনের ছোট ভ্যান কিংবা রিকশাসহ নানা ধরনের বাহন নিয়েও চলাচল করে মানুষ। কিন্তু মিডিয়ান গ্যাপ না থাকায় এসব বাহনকে ট্রাফিক আইন মেনে ১৫/২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়তি ঘুরতে হয়। এজন্য অধিকাংশ সময় আইনের তোয়াক্কা না করে চরম ঝুঁকি নিয়ে এসব গাড়ি উল্টো পথে চলাচল করে। ফলে এসব গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় হাইওয়ে পুলিশকে। এছাড়া উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির কারণে মহাসড়কে চলাচলকরা গাড়িগুলোর গতিও ব্যাহত হচ্ছে। অনেক সময় যানজটে আটকা পড়ে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাস্তাটির সুফল পুরোপুরি যেমন মিলছে না, তেমনি উল্টো পথে আসা গাড়িগুলোও বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিটি গেট থেকে শুরু করে সীতাকুণ্ড এবং মীরসরাইর বিস্তৃত এলাকায় মিডিয়ান গ্যাপের অভাবে প্রতিদিন শত শত গাড়ি উল্টো পথে চলাচল করছে। রাস্তার দুদিকেই দেখা গেছে উল্টো গাড়ির সারি। উল্টো দিকের এসব গাড়ির পাশ কাটিয়ে নির্দিষ্ট রাস্তায় থাকা গাড়িগুলোকে চরম সতর্কতা ও নিয়ন্ত্রিত গতিতে এগুতে হচ্ছে। উল্টো পথের গাড়িগুলোর গতিও থাকে সীমিত। তবুও মহাসড়কে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও উল্টো পথের গাড়ির সাথে সোজা পথে থাকা গাড়িগুলোর ছোটখাট সংঘর্ষ হচ্ছে। হাইওয়ে পুলিশও দিনরাত এসব গাড়ির ধকল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
উল্টো পথ ধরে আসা সীতাকুণ্ডের পন্থিছিলা এলাকার জনৈক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে জানান, তার বাড়ি কেদারখীল এলাকায়। শহর থেকে যাওয়ার সময় তার কোনো সমস্যা না হলে ফেরার পথে তার বড় সমস্যা হয়। পন্থিছিলা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে শেখপাড়ায় মেডিয়ান গ্যাপ দিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এজন্য পন্থিছিলা থেকে শেখ পাড়া পর্যন্ত এক কিলোমিটার জায়গা তাকে উল্টো পথে আসতে হয়। এটি করতে গিয়ে প্রতিদিনই তাকে চরম বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। পুলিশের জরিমানাও গুণতে হচ্ছে। কিন্তু এটি না করে সঠিক পথে যেতে তাকে উত্তর দিকে সাত কিলোমিটার গিয়ে বড় দারোগারহাট ঘুরে আসতে হয়। ফলে উভয় পথে তাকে ১৪ কিলোমিটার অতিরিক্ত ঘুরে শ’ খানেক টাকার জ্বালানি এবং ২০/২৫ মিনিট সময় নষ্ট করতে হয় বলে জানান তিনি। ওই ব্যক্তি আরো জানান, শেখপাড়া থেকে বড় দারোগারহাট পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকায় কোনো মেডিয়ান গ্যাপ না থাকায় অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটির হাজার হাজার মানুষকে প্রতিদিন চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। বড় ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সীতাকুণ্ডের তিন ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ।
একই ধরনের অবস্থা সীতাকুণ্ডের আর আর জুট মিলের পাশ থেকে কুমিরা পর্যন্ত এলাকায়। পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকায় কোনো মেডিয়ান গ্যাপ নেই। মীরসরাইতেও একই ধরনের অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে। এতে হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগের পাশাপাশি ‘জীবন হাতে নিয়ে’ চলাচল করার মতো ঘটনাও ঘটছে।
এই ব্যাপারে গতকাল সড়ক ও জনপথ বিভাগের পদস্থ একজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মেডিয়ান গ্যাপের বিষয়টি এলাকার বসতি, প্রয়োজনসহ বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে করা হয়। রাস্তাটি যখন প্রশস্ত করা হয়েছিল তখন বিষয়গুলো খেয়াল করে করা হয়েছিল। ঘন ঘন মেডিয়ান গ্যাপ থাকলেও যান চলাচলের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সীতাকুণ্ড এবং মীরসরাইর মেডিয়ান গ্যাপ নিয়ে তিনি শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা করবেন বলেও দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন।