এখন শীতের মৌসুম। হাট–বাজার, দোকান–পাঠ, অলি–গলি শাক সবজিতে ভরপুর। কিন্তু এই শাক–সবজি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যচক্রে কতটুকু সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দিচ্ছে? তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক সোয়াতলানা আলেক্সিয়াভিচ, যিনি ২০১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কারণ তৎকালীন রাশিয়ার (বর্তমানে ইউক্রেন) চেরনোবিল পারমানবিক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় দশ হাজার ভুক্তভোগি মানুষের সাক্ষাৎকারমূলক এক অসাধারণ ঐতিহাসিক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম ‘চেরনোবিলের আর্তনাদ’ ইংরেজীতে ‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল’। অন্যান্য অনেক গ্রন্থ রচনা করলেও, মূলত এই গ্রন্থটির জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এই গ্রন্থটির সপ্তম অধ্যায়ে তিনি লিখেন– ‘পারমানবিক তেজস্ক্রিয়তা যেমন মানুষকে খুব ধীরে ধীরে বিকলাঙ্গ করে দিচ্ছে, ঠিক তেমনি শাক–সবজির উপর যথেচ্ছ কীটনাশক বা বালাই নাশক ব্যবহারও মানুষকে তার খাদ্য চক্রের মাধ্যমে নীরবে নিভৃতে বিকলাঙ্গ থেকে অসংক্রিজনিত মরণ ব্যাধির দিকে ঠেলে দিচ্ছে নিয়ত’।
ডেভিড ম্যাকমিলান একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী, যিনি ১৯৮৩ সালে তৎকালীন রাশিয়ার চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর থেকে চেরনোবিলের প্রাণ প্রকৃতি ফিরে পাওয়ার জন্য গভীর গবেষণা করেছেন। দীর্ঘ গবেষণা করে তিনি চেরনোবিলের তেজষ্ক্রিয়তার ফলে বিবর্ণ–ধূসর চারপাশ কীভাবে চাষ–বাসের উপযোগী হয়ে উঠে এবং কীভাবে চেরনোবিল আবার ফুলে–ফলে জঙ্গলে ভরে উঠলো তাঁর প্রামাণ্য চিত্র নিয়ে একটি অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেন। প্রচুর আলোক চিত্র সহ গ্রন্থটির নাম দেন তিনি– ‘গ্রোথ এন্ড ডেকাসি’। তাতে তিনি বিশদ ব্যাখ্যা দেন যে, কীটনাশক বা বালাইনাশক ছাড়া শাক–সবজি ও ফলমূলের বাগান কিভাবে চিরহরিৎ হয়ে উঠে। তিনি এও দেখান যে সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও পরিশ্রম থাকলে কিভাবে তেজস্ক্রিয়তায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি ভূখণ্ড চির সবুজ হয়ে উঠে। তাতে মানবদেহের জন্য সুফল দেয় এরকম শাক–সবজির বাগান পারমানবিক দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তার বিষাদ কাহিনিকে ভুলিয়ে দেয়। তিনি আলোক চিত্রমূলক ওই গ্রন্থটি রচনা করেন ১৯৮৬ সালের পারমাণবিক দুর্ঘটনার প্রায় ১০ বছর পর। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, মসলা ইত্যাদির মতো শাক–সবজিও আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার একটি অপরিহার্য অংশ। তাই আমরা কী খাচ্ছি তা স্বাস্থ্যের উপযোগী কিনা, তা বারবার চিন্তা–ভাবনায় আনা দরকার।
বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ায় বিভিন্ন মৌসুমে প্রচুর শাক–সবজি উৎপন্ন হয়। এ সব শাক–সবজিতে প্রতি বছরই বিভিন্ন পোকা–মাকড় ও রোগ–বালাইয়ের আক্রমণ হয় এবং কোনো কোনো সময় এর ফলে মারাত্মক ক্ষতি হয়। স্মর্তব্য, বাংলাদেশে শুধু পোকা–মাকড় দ্বারাই প্রতি বছর প্রায় ১০–১৬ শতাংশ ফসল নষ্ট হচ্ছে। যার মূল্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
শাক–সবজিকে রোগ ও পোকা–মাকড়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য কৃষকরা প্রতিনিয়ত যথেচ্ছভাবে যতত্রতত্র মাত্রাহীন পরিমাণে বিভিন্ন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার করে যাচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ১০–১২ হাজার মে. টন কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এর অধিকাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে শাক–সবজিতে।
শতকরা ১০০ জন কৃষক কীটনাশক নিরাপদভাবে ব্যবহার করে না এবং ৮০ % কৃষক ফসলের অর্থনৈতিক ক্ষতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছার পূর্বেই কীটনাশক প্রয়োগ করে। শাক–সবজিতে এরূপ নির্বিচারে এলোপাতাড়ি কীটনাশক ব্যবহারের ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অপরদিকে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
বর্তমান বিশ্বে কীটনাশক এক শত্রু হিসেবে একের পর এক নীরবে ধ্বংস করে চলেছে মানবদেহকে। এমন কোনো কীটনাশক নেই যা মানবদেহের জন্য কম–বেশি বিষাক্ত নয়। প্রায় প্রতিটি কীটনাশকেরই রয়েছে অল্পবিস্তর অবশিষ্ট প্রভাব বা রেসিডিউল ইফেক্ট। অধিকাংশ শাক–সবজি অনিয়মিতভাবে ক্ষেত থেকে বিভিন্ন সময় সংগ্রহ বা তোলা হয় এবং কাঁচা বা অল্প রান্না করে খাওয়া হয়। আর এ কারণে কীটনাশক প্রয়োগকৃত শাক–সবজি থেকে আমরা প্রতিদিন ভয়াবহ বিষাক্ত দ্রব্যটিকে উদরস্থ করে ক্রমশ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। পেটের বিভিন্ন পীড়া এর অন্যতম কারণ।
কোনো কোনো কীটনাশকের প্রভাব এত বেশিদিন থাকে যে তা একবার আমাদের দেহে প্রবিষ্ট হলে তা সহজে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায় না। বরং এ জাতীয় কীটনাশকের কণা দেহে ক্রমে সঞ্চিত হতে হতে আমাদের বিকলাঙ্গ বা বন্ধ্যা করে তোলে। নিয়মনীতিহীন কীটনাশকের ব্যবহার এ পরিস্থিতিকে আরো বেশি জটিল করে তুলেছে। আর পরিবেশ দূষণতো রয়েছেই। একদিকে কীটনাশক ব্যবহার করে চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে পরাগায়নে সাহায্যকারী বিভিন্ন পোকা–মাকড়কে আর ক্ষেতে দেখা যাচ্ছে না। যে কারণ ফলনও মারাত্নকভাবে কমে যাচ্ছে। এসব সমস্যার কথা চিন্তা করে কৃষিতে অগ্রসর অনেক দেশে এখন কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প দমন ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে-‘মোর পেস্টিসাইড মোর পেস্ট, লেস পেস্টিসাইড লেস পেস্ট’। অর্থাৎ কীটনাশকের ব্যবহার যত কমানো যাবে পোকা–মাকড়ের আক্রমণও তত কমে যাবে। এই ধারণা থেকে ইন্দোনেশিয়ায় প্রচলিত ৬৪টি কীটনাশকের মধ্যে ১৯৮৬ সালে ৫৭টি কীটনাশক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে তাদের উৎপাদন কমেনি বরং ক্ষতিকর পোকা–মাকড়ের সংখ্যা কমেছে। কেননা কীটনাশকের সহজলভ্যতা হ্রাস পাওয়ায় এর ব্যবহার কমেছে এবং ক্ষেতে বিভিন্ন উপকারী পোকা–মাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে যারা প্রকৃত পক্ষে ঐসব ক্ষতিকর পোকা বা তাদের ডিম ও ক্রিয়াকে নষ্ট করে। সম্প্রতি ভারত, তাইওয়ান, কলম্বিয়া ইত্যাদি দেশে ফসলের পোকা–মাকড় দমনে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কীটনাশকের ব্যবহার বিপুল পরিমাণে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, অথচ এতে ফসলের উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ গিয়েছে কমে।
এদেশেও বিভিন্ন ফসল বিশেষত শাক–সবজির পোকা–মাকড় দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে কীটনাশকের ব্যবহার একবারেই ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার অথবা কীটনাশকের ব্যবহার পরিহার করা উচিত। অবশ্য শাক–সবজি বা বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার একেবারে বাদ দেয়া সম্ভব হবে না। কেননা আবহাওয়াগত কারণে অনেক সময় বিভিন্ন পোকার আক্রমণ দ্রুত চরম অবস্থা ধারণ করতে পারে। তাই পরিবেশকে দূষণমূক্ত রাখতে এবং সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য সর্বোপরি কৃষকের অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে এ মুহূর্তে পোকা–মাকড় দমনে শাক–সবজিতে কীটনাশকের ন্যূনতম/ যুক্তিসংগত ও নিরাপদ ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত।
মানুষের অবিমৃশ্যকারিতার কারণে, মানুষের স্বাস্থ্য, জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রাণ প্রকৃতি আজ চরম বিপন্ন। বিবেচনাহীন ও অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে, প্রকৃতির পরিছন্নতা কর্মী শকুনের মতো প্রকৃতির অসংখ্য উপকারী কীট–পতঙ্গ, পশু–পাখি, জীব–জন্তু ও উদ্ভিদ আজ বিলুপ্তির পথে। কোভিড–১৯ মহামারির সময়ে আমরা দেখেছি প্রকৃতি কিভাবে প্রতিশোধ নেয়, তার উপরে বিবেচনাহীন অত্যাচার জন্য। অতিরিক্ত ডাইক্লোফেনাক ব্যবহারের ফলে এই বাংলা থেকে সকল শকুন আজ প্রায় বিলুপ্ত। ঠিক সেরকম অপ্রয়োজনীয় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে শাক–সবজি ও ফল মূলের বিষক্রিয়ায় মানব জাতিও যে কোনদিন ধ্বংসের মখোমুখি হতে পারে। ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং মহামারি সারা বিশ্বের সরবরাহ শৃঙ্খলকে নষ্ট করেছে। যার কারণে এখন প্রয়োজনীয় শস্য সরবরাহও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পণ্যের দাম ও জ্বালানির ব্যয়ও নজিরবিহীন ভাবে বেড়ে গেছে। এতে অধিক উৎপাদনের আশায় বর্তমানে শাক–সবজিসহ সকল নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে কীটনাশক ও ফরমালিনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এও তো ঠিক জাতিসংঘ বার বার বলছেন, ভবিষ্যতে এই বিশ্ব ক্ষুধা ও মহা খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। তাই আমাদের কীটনাশক ব্যবস্থাপনার উপর অতিরিক্ত নজরদারি প্রয়োজন। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) ভাষ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে বিশ্বে প্রতি রাতে ৮২ কোটি ৮০লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাচ্ছে (প্র.আলো ১৯ ডিসেম্বর’২২)। কিন্তু তা বলে খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্য মানবদেহের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে এরকম কীটনাশকের ব্যবহারও সমীচীন নয়।
জীবনের জন্য খাদ্য কিন্তু খাদ্যের জন্য জীবন নয়। তাই জীবনকেই আগে প্রাধান্য দিয়ে খাদ্য–শস্য ও শাক–সবজি সহ সবকিছু উৎপাদনের জন্য আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করে মানব দেহের জন্য কম ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহারের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।