নীরব দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে কথকতা

চিকিৎসা শ্রমিকের পথচলা

ডা: হাসান শহীদুল আলম | বৃহস্পতিবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেজন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতে দুর্ভিক্ষ, নীরব দুর্ভিক্ষ, খাদ্য নিরাপত্তা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করছি।

খাদ্য নিরাপত্তা: রাষ্ট্রীয় পরিসরে সকল নাগরিক যেন সব সময়ের জন্য তাদের প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণে অধিগম্যতা প্রাপ্ত হয়। এ ক্ষেত্রে খাদ্যের জোগান ব্যবস্থা অটুট থাকা ও নাগরিকদের বাজার থেকে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনে খাওয়ার সামর্থ্য অর্জনই মূল কথা। খাদ্যের জোগানের পর্যাপ্ততা, পুষ্টিগুণ, নিরাপদ হওয়া ও সকল নাগরিকের অধিগম্যতাএই চারটি হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তার পূর্বশর্ত।

দুর্ভিক্ষ: বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী এর ভাষায় বলতে গেলে, কোনো এলাকায় যদি ২০ শতাংশ মানুষ কঠিন পর্যায়ের খাদ্যাভাবে ভুগে এবং ৩০ শতাংশ শিশু যদি তীব্র পুষ্টিহীনতায় ভুগে এবং প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে যদি ২ জন ক্ষুধা, অনাহার, রোগ এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যায় মৃত্যুবরণ করে তাহলে তাকে দুর্ভিক্ষ বলা হয়ে থাকে।

নীরব দুর্ভিক্ষ ও দুর্ভিক্ষাবস্থা: নীরব দুর্ভিক্ষ বা হিডেন হাঙ্গার হচ্ছে দুর্ভিক্ষের প্রথম ধাপ। মানুষ যখন প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয় এবং এমনি ব্যর্থ মানুষের সংখ্যা যখন অনির্দিষ্ট হারে বাড়তে থাকে সে অবস্থাকে নীরব দুর্ভিক্ষ বলা হয়। বাজারে যখন খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে তখন শর্করা বা চাল, আটা, ডাল, শাকসবজি ইত্যাদি থেকে আমিষ, ফ্যাট অর্থাৎ মাছ, মাংস, ডিম এর মূল্যবৃদ্ধি অনেক বেশি ঘটে থাকে যা ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এ অবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষরা অধিক পুষ্টিকর আমিষ, ফ্যাট বাদ দিয়ে কম পুষ্টিকর শর্করার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ অবস্থা যখন দীর্ঘস্থায়ী হয় তখন সামগ্রিক জনগোষ্ঠী অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে। একে নীরব দুর্ভিক্ষাবস্থা বলা হয়। অপুষ্টির কারণে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যাবার ফলে মানুষ দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করতে তাকে। তেমনি অবস্থাকে দুর্ভিক্ষাবস্থা বলে।

বিশ্বে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের আশংকা: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এএফও এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী বা ডব্লিউএফপি এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে যে ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ‘বিগত ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০২২ জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান ডেভিড বিসলি বলেন, বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে শিগগিরই এই সংখ্যার সঙ্গে আরও ৭০ কোটি মানুষ যুক্ত হবেন [ নিউজ ২৪,১৬০৯২৩]।’

নীরব দুর্ভিক্ষ তথ্যাদি: () ‘সারা দিনে এক বেলাও খেতে পায়নি প্রায় ৩ শতাংশ শহুরে দরিদ্র পরিবার। শহরের ৮ শতাংশ দরিদ্র পরিবার না খেয়ে ঘুমাতে যায়। শহরের ১২ শতাংশ দরিদ্র পরিবারে খাবার নেই। ২১ শতাংশেরও বেশি দরিদ্র পরিবারে পর্যাপ্ত খাবার নেই। ৭ শতাংশ পরিবার কম পরিমাণে খাচ্ছে [ডেইলী ষ্টার, ২১১২২০ }।’ () ‘দেশে ১ হাজার ৬০০ পরিবারের উপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৮০.৬০ শতাংশ মানুষ খাদ্যের ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। ৬৪.৫০ শতাংশ মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ও কমিয়ে দিয়েছে। ঋণ নিচ্ছে ৬০.৮০ শতাংশ মানুষ। ৪৭.২০ শতাংশ মানুষ প্রোটিন খাওয়া কমিয়ে দিয়ে মাছ মাংস এড়িয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে। কেউ কেউ তিন বেলার বদলে এক বেলা কি দুই বেলা করে খাচ্ছে। ১০ শতাংশ মানুষ শিশু খাদ্য কেনাও বন্ধ করে দিয়েছে [ বনিক বার্তা, ১৪০১২৩]।’ () ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগের সামপ্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের ৩০৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রয়োজনের তুলনায় ৭টি অনুপুষ্টি অপর্যাপ্ত পরিমানে গ্রহণ করে। এর ফলে তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে [জাগোনিউজ ২৪ ডট কম, ১৬১০২২ ]।’() ‘সরকারের কাছে খাদ্যশষ্য আছে ১৬ লাখ টনের মতো। আমন চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজন অনেক বেশি। এক কোটিরও উপর গরীব পরিবারকে খাদ্যশষ্য দিতে হবে। যুগান্তর, ০৩০২২৩]।’

বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের বৈশ্বিক কারণ: () রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পরিবহন এবং খাদ্য প্রাপ্তির বিশ্বব্যাপী সমস্যার সাথে বাংলাদেশ জড়িয়ে গিয়েছে। বিশ্বের ৪০ শতাংশ খাদ্যের জোগানদাতা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পর্যাপ্ত গম, সানফ্লাওয়ার, শস্য এবং সার উৎপাদন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার কারণে পর্যাপ্ত শস্য রফতানী হচ্ছে না। প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল উৎপাদনে ও রফতানীকারক হিসাবে ২য় স্থানে আছে রাশিয়া। নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ইউরোপে তেল ও গ্যাস রফতানী করতে পারছে না। যথাযথ আমদানী ও রফতানী করতে না পেরে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের ঘাটতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। যা আসন্ন দুর্ভিক্ষের জন্য তীব্র হুমকীর কারণ। () পৃথিবীর বিভিন্ন খাদ্য রফতানীকারক দেশ কর্তৃক খাদ্য রফতানী বন্ধ করা কিংবা রফতানী নিরুৎসাহিত করার জন্য শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। () পৃথিবীর অনেক দেশে বন্যা ও খরার কারণে খাদ্য উৎপাদন কমেছে। ()করোনা বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সেটি এখনও কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। () বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৯ সালের তূলনায় এখন তাদের পরিচালন ব্যয় যতটা বেড়েছে সেটি দিয়ে তারা প্রতি মাসে ৪০ লাখ মানুষকে খাওয়াতে পারবে [ নয়া দিগন্ত, ১৪১০২২]।’

বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের দেশীয় কারণ: () ২০২২ সালে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমন ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এবার ফসলহানি হয়েছে এবং আগামীতে এটা আরো বাড়বে। () ধান গবেষণা ইনসটিটিউট এর তথ্য মতে, সেচের বাড়তি খরচ, সারের দাম, এবং শ্রমিকের বাড়তি মজুরীর কারণে এবার আমনের উৎপাদন খরচ ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। () যাদের কাছ থেকে আমরা খাদ্য আমদানী করি, তারা নিজেদের প্রয়োজনেই খাদ্য নাও দিতে পারে। () সিপিডি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেভাবে কমতে চলেছে তাতে আগামীতে ডলার সংকটে খাদ্য আমদানী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তখন আমাদের হাতে আমদানী করার মতো ডলার থাকলেও আমরা খাদ্য নাও পেতে পারি। () অব্যাহত মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে পন্য থাকার পরেও নিম্ন আয়ের মানুষের সেগুলো কেনার সামর্থ্য নাও থাকতে পারে।

বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে করণীয় :

() প্রতিটি উপজেলায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত খাদ্য সংরক্ষাণাগার গড়ে তোলা, () সরকারকে কিছু ভর্তুকি দিয়ে হলেও ডিজেল বিদ্যুতের মূল্য কিছুটা কমিয়ে আনা, () খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতা বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষ যাতে খাদ্য পায় তার ব্যবস্থা করা, () সকল পতিত জমি চাষের আওতায় আনা, () পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ে সয়াবিন গাছ লাগিয়ে সয়াবিন উৎপাদনের পাশাপাশি সারা দেশে সরিষা চাষের জন্য সরকারের বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা, () কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সার ও কীটনাশক বিতরণ করা, () কৃষকদের বিনা সুদে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ প্রদান করা, () বিদেশ থেকে আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক পণ্য, সিগারেট, কসমেটিক ও পোশাক আমদানী নিষিদ্ধ করে বৈদেশিক মুদ্রার উপরে চাপ কমানো।

উপসংহার :

আলোচনার সারমর্ম হিসাবে বলতে চাই যে, কর্তৃপক্ষ স্বীকার করুক বা না করুক উল্লিখিত তথ্য সমূহের বিশ্লেষণে দেশে নীরব দুর্ভিক্ষের বৈশিষ্ট্যসমূহ স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। অতএব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু পদক্ষেপ নেয়া চাই।

লেখক : ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে, স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধজলবায়ু ন্যায়বিচার ও পরিবেশগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ