নীরবতার মাঝেই লুকিয়ে আছে শান্তি ও সৃজনের আলো

সাইফ চৌধুরী | সোমবার , ২৪ নভেম্বর, ২০২৫ at ৭:১৯ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান যুগে মানুষ দিনদিন শব্দ আর কোলাহলে ডুবে যাচ্ছে। শহরের যানজট, যান্ত্রিক কাজের চাপ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবিরাম ব্যস্ততা সব মিলিয়ে মনের ভেতরের শান্ত স্থানটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই নীরবতাই মানুষের অন্তর্জগতের দরজা খুলে দেয়। নীরবতা শুধু বিশ্রামের মাধ্যম নয়, এটি এক ধরনের শক্তি যা চিন্তাকে গভীর করে, মনোযোগ বাড়ায় এবং সৃজনশীল চিন্তার জন্ম দেয়।

নীরবতা মানুষকে আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ দেয়। এতে নিজের সীমাবদ্ধতা বোঝা যায়, ভাবনাগুলো পরিষ্কার হয়, মানসিক অস্থিরতা কমে যায়। আজকের দ্রুতগতির জীবনে এ নীরবতার মুহূর্তগুলো মানসিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি সৃজনশীলতা জাগিয়ে তোলার পথও তৈরি করে। তাই জীবনে যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন, একটু নীরবতার সময় রাখা জরুরি। নীরবতা শুধু মানসিক প্রশান্তির আশ্রয় নয়, এটি ভাবনার বীজ রোপণের ক্ষেত্রও। নীরবতার ভেতরেই জন্ম নেয় নতুন ধারণা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা।

নীরবতা ও অন্তরের চিন্তার জগৎ : চিন্তা সবসময় শব্দে প্রকাশ পায় না। অনেক সময় তা জন্ম নেয় নিঃশব্দ মুহূর্তে, যখন মন শান্ত থাকে। নীরবতা ঠিক সেই মুহূর্ত তৈরি করে। এটি এক ধরনের মানসিক বিশ্রাম, যেখানে মস্তিষ্ক অস্থিরতা থেকে মুক্ত হয়ে গভীর মনোযোগে ঢুকে পড়ে। এই অবস্থায় মানুষ তার চিন্তাকে গুছিয়ে নিতে পারে, অনুভব করতে পারে কোন ভাবনাটি সত্যিই তার নিজের।

শিক্ষার্থীর জীবনে এই নীরবতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিনের পড়াশোনা, পরীক্ষা, প্রতিযোগিতা, সামাজিক চাপ, সব মিলিয়ে তার মন যেন সর্বদা ব্যস্ত থাকে। কিন্তু যদি সে প্রতিদিন কিছু সময় নীরবে বসে নিজের শেখা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবে, তাহলে সেই শিক্ষার মান সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। কারণ নীরবতা শেখায় নিজের ভেতরের প্রশ্নগুলো শোনা, যা থেকেই জন্ম নেয় প্রকৃত বোঝাপড়া।

নীরবতা মস্তিষ্কের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া : নীরবতা কেবল আবেগ নয়, এটি একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াও। যখন পরিবেশ শান্ত থাকে, তখন মানুষের মস্তিষ্ক নিজের ভেতরে নতুন সংযোগ তৈরি করে। এই সময়ে অপ্রয়োজনীয় তথ্য বাদ পড়ে যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক অর্থে নীরবতা মস্তিষ্কের জন্য ঠিক সেই কাজটিই করে, যা পরিচ্ছন্ন বাতাস ফুসফুসের জন্য কাজ করে।

কিন্তু আমরা আজ এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে মানুষ অবিরাম তথ্যের স্রোতে ভেসে চলেছে। প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু দেখছে, শুনছে, পড়ছে। ফলে চিন্তার কোনো নীরব জায়গা আর অবশিষ্ট নেই। অথচ সৃজনশীলতার জন্য এই নীরব মুহূর্তগুলোই সবচেয়ে জরুরি। এগুলোই মানুষকে শেখায় তথ্য নয়, তার অর্থ বুঝতে।

শিক্ষার্থীদের জন্য নীরবতার বাস্তবিক প্রয়োগ : . নীরবতা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায়। ২. এটি মনোযোগ বৃদ্ধি করে ও শেখার পরিবেশকে শান্ত রাখে। ৩. নীরব থেকে চিন্তা করলে ভাবনার গভীরতা বাড়ে এবং জ্ঞান অর্জন সহজ হয়। ৪. পরীক্ষার আগে নীরব অবস্থায় পুনরাবৃত্তি করলে স্মৃতিশক্তি সক্রিয় হয়। ৫. নীরবতা আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ দেয় যা শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ৬. নীরবতা আত্মসংযম শেখায় এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখে। ৭.পড়াশোনার চাপ বা বিভ্রান্তি কমাতে এটি মানসিক প্রশান্তি আনে। ৮. নীরব অভ্যাস শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তোলে। ৯. এটি মনকে স্থির রাখে এবং চিন্তাশক্তিকে ধারালো করে। ১০. পাঠে মনোযোগী হতে ও সৃজনশীল ধারণা গঠনে নীরবতা কার্যকর ভূমিকা রাখে। ১১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট সময় নীরব চিন্তার চর্চা করা উপকারী। ১২. এটি দলগত আচরণে সৌহার্দ্য আনে এবং পারষ্পরিক বিরোধ কমায়। ১৩. নীরবতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা ও ধৈর্যের গুণ জাগ্রত করে। ১৪. নীরবতার মাধ্যমে শিক্ষার্থী নিজেকে ও পৃথিবীকে গভীরভাবে বুঝতে শেখে। ১৫. আধুনিক যুগে তথ্যের ভিড়ে নীরবতা মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করে। ১৬. এটি শিক্ষার্থীদের চিন্তা, আচরণ ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনে।

প্রযুক্তি নির্ভর যুগে নীরবতার প্রয়োজন : আজ পৃথিবী যত এগিয়েছে, ততই বেড়েছে শব্দের মাত্রা। ফোনের নোটিফিকেশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অস্থিরতা, অবিরাম তথ্যপ্রবাহ সব মিলিয়ে মানুষ নিজের ভাবনার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় নীরবতা হয়ে উঠতে পারে এক নতুন প্রযুক্তিগত দক্ষতা।

নীরবতা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানসিক ভারসাম্যের অপরিহার্য শর্ত। যেমন যন্ত্রের ব্যাটারি চার্জ নিতে হয়, তেমনি মানুষের মস্তিষ্ককেও মাঝে মাঝে নীরবতার মাধ্যমে পুনর্জীবিত হতে হয়। কিন্তু এ নীরবতা কেবল বাহ্যিক নয়, তা হতে হবে অন্তরেরও। চোখ বন্ধ করে বসে থাকা নীরবতা নয়; বরং মনোযোগী চিন্তার এক নিভৃত অবস্থা, যেখানে মানুষ নিজের ভেতরের অপ্রকাশিত অংশের সঙ্গে দেখা করে।

নীরবতার নতুন উপলব্ধি : নীরবতা কেবল নীরব বসে থাকা নয়। এটি এক সক্রিয় ভাবনাপ্রক্রিয়া। যখন আমরা নীরব থাকি, তখন আমাদের মন কাজ করে সবচেয়ে গভীর স্তরে। নীরবতা সেই অদৃশ্য স্থপতির মতো, যে ভিতরের জগতে চিন্তার কাঠামো তৈরি করে। এই কাজটি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু এর ফলেই দাঁড়ায় নতুন ধারণার ভিত্তি। মানুষ সাধারণত কথা বলে যা জানে তা প্রকাশ করে, কিন্তু নীরবতার মধ্যে সে যা জানে না, তা অনুসন্ধান করে। নীরবতার এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়াই মানুষকে নতুন কিছু ভাবতে শেখায়, যা অন্যরা এখনও ভাবেনি।

নীরবতা ও মানব কল্যাণ : নীরবতা মানুষের অন্তরের শান্তি ও স্থিতির উৎস। জীবনের কোলাহল, দৌড়ঝাঁপ ও প্রতিযোগিতার মাঝে নীরবতা মানুষকে মানসিক প্রশান্তি দেয়। এটি আমাদের মনোযোগ বৃদ্ধি করে এবং চিন্তাকে স্পষ্ট করে। নীরব পরিবেশে মানুষ নিজের জীবনের দিকনির্দেশনা ভালোভাবে বুঝতে পারে। যখন আমরা নীরব থাকি, তখন অন্যের কথাও ভালোভাবে শোনা যায়। এতে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্মান বাড়ে। নীরবতা রাগ ও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। অপ্রয়োজনীয় কথা বা তর্ক এড়িয়ে নীরব থাকা অনেক সময় বড় সমস্যা প্রতিরোধ করে। নীরবতা আমাদের ধৈর্য শেখায়, যা মানবিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে অপরিহার্য। যে ব্যক্তি নীরবতার মূল্য বোঝে, সে সাধারণত শান্ত, স্থির ও বিচক্ষণ হয়। নীরবতার মাধ্যমে মানুষ নিজের ভুলগুলো অনুধাবন করতে পারে। এটি আত্মশুদ্ধির পথও খুলে দেয়। নীরবতা মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা ও সহনশীলতা গড়ে তোলে। সমাজে শান্তি ও সমপ্রীতি বজায় রাখতে নীরবতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি অন্যের প্রতি সহানুভূতির মানস গঠন করে। নীরবতা শুধু কথার বিরতি নয়, এটি মননের এক গভীর প্রশান্তি।

মানব উন্নয়নের দিকনির্দেশ হিসেবে নীরবতা : নীরবতা হলো মনের এক উন্মুক্ত ক্ষেত্র, যেখানে নতুন ভাবনার বীজ অঙ্কুরিত হয়। এটি আত্মশিক্ষার সবচেয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতি। ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থায় নীরবতাকে শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যেমন নীরব পাঠ, নীরব চিন্তা, বা নীরব আত্মমূল্যায়ন।

এই নীরবতার চর্চা শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও আত্মবিশ্বাস বাড়াবে, আর সমাজে আনবে পরিশীলিত ভাবনা ও মানবিকতা। নীরবতা এক প্রকার মানসিক ল্যাবরেটরি, যেখানে মানুষ শব্দ নয়, মনের মাধ্যমে কাজ করে। আর যখন সেই মন পরিপক্ব হয়, তখন তার প্রতিটি উচ্চারণ হয়ে ওঠে অর্থবহ ও প্রভাবশালী।

নীরবতা কোনো শূন্যতা নয়; এটি এক গভীর সত্তা, যা মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ও সৃষ্টিশীলতার ভেতরে প্রাণ সঞ্চার করে। এটি শেখায় যে শব্দের চেয়ে চিন্তা, প্রতিক্রিয়ার চেয়ে প্রতিফলন, এবং জ্ঞানের চেয়ে উপলব্ধি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজ পৃথিবী দ্রুতগতির, তথ্যনির্ভর, কিন্তু যদি এই গতি ও তথ্যের ভিড়ে মানুষ নীরবতার প্রশান্তি হারায়, তবে সে নিজেকেও হারাবে। তাই এখন সময় এসেছে নীরবতাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করা। এটি পুরোনো অভ্যাস নয়, বরং ভবিষ্যতের বুদ্ধিমত্তার মূল কৌশল। যে মানুষ নীরবতাকে ধারণ করতে জানে, সে নিজের সীমার মধ্যে অসীমকে অনুভব করতে পারে। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে মানবতার প্রকৃত আলো নীরব, অথচ দীপ্তিময়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, বিতার্কিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজি. এম. জহির উদ্দিনের ‘খোকার চোখে স্বপ্ন আঁকে’
পরবর্তী নিবন্ধপ্রথম বাঙালি পুঁথিসংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ