সহকারী স্টেট অফিসার–এর একটি শূন্য পদে নিয়োগের জন্য গত এপ্রিল মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। নির্ধারিত সময়ে ওই পদের বিপরীতে আবেদন করে ৮৩৫ জন। একটি পদের বিপরীতে এত বিপুল সংখ্যক প্রার্থী হওয়ার নজির নেই সংস্থাটিতে।
অবশ্য বিজ্ঞপ্তিটি ছিল সহকারী স্টেট অফিসারসহ ২২ ক্যাটাগরির শূন্যপদের বিপরীতে ১২৩ জনবল নিয়োগের লক্ষ্যে। শূন্যপদগুলোর বিপরীতে মোট ৩৫ হাজার ৬৬৩ জন আবেদন করে। অর্থাৎ প্রতি পদের বিপরীতে গড়ে প্রার্থী হয়েছেন ২৮৯ জন। এছাড়া সবচেয়ে বেশি ৯ হাজার ৫৫৩ টি আবেদন পড়েছে ওয়ার্ড সেক্রেটারি পদের বিপরীতে। আগামী ১০ অক্টোবর থেকে ধাপে ধাপে নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া হবে।
চসিকের সচিবালয় শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২২ ক্যাটাগরির শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে তা হবে দীর্ঘ কয়েক বছর পর ‘নিয়ম’ মেনে হওয়া জনবল নিয়োগ। যেখানে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করা হবে। এর আগে চসিকে বেশিরভাগ নিয়োগ হয়েছে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া। সর্বশেষ রেজাউল করিম চৌধুরী মেয়র থাকাকালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই চসিকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয় ২৫০ জন কর্মচারী। এদের বেশিরভাগকে নিয়োগ দেয়া হয় শ্রমিক হিসেবে। কিন্তু পরবর্তীতে পদায়ন করা হয় বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে। ‘অস্বচ্ছ’ প্রক্রিয়ায় হওয়া এ নিয়োগের বিষয়টি বর্তমানে তদন্ত করছে দুদক।
অবশ্য রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়াদকালে ২০২২ সালে ১১ জন প্রকৌশলীসহ ১৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হয় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং পরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু এ নিয়োগ নিয়েও আছে নানা অভিযোগ। বিষয়টিও তদন্তের নির্দেশ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এর আগে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকালেও বিজ্ঞপ্তি ছাড়া নিয়োগ দেয়া হয়েছে চসিকে। এসময় ডোর টু ডোর প্রকল্পে নিয়োগ দেয়া ২ হাজার জনকে। যেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সবগুলো ধাপ অনুসরণ করা হয়নি। একইভাবে আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকালে চসিকে সৃষ্ট পদের অতিরিক্ত ৭৩ জন বৈদ্যুতিক হেলপার কর্মরত ছিলেন। এরপরও এ পদে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া নিয়োগ দেয়া ২৭ জনকে। সংস্থাটির পৃথক দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে বিষয়গুলো ওঠে আসে। নিয়োগের পর ওই ২৭ জনের বেশিরভাগকে অন্য পদে পদায়ন করা হয়।
জানা গেছে, সাবেক মেয়রদের মেয়াদকালে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া অস্থায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে পছন্দের চাকরিপ্রার্থীর আবেদনে ‘বিধিমতে ব্যবস্থা নিন’ লিখে সচিবকে নির্দেশনা দিতেন মেয়র। সচিব নথি তৈরি করে মেয়রের কাছে উপস্থাপন করতেন। মেয়র সেখানে ‘কাজ নেই, মজুরি নেই’ ভিত্তিতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত করা হউক’ লিখে অনুমোদন দিতেন। এরপর চাকরিপ্রার্থীকে মর্জি মত বেতন নির্ধারণ করে নিয়োগপত্র দেয়া হতো।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেও হয়নি নিয়োগ : ৮০০ শূন্যপদ পূরণে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পৃথক ছয়টি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। এতে ৫০ হাজারের অধিক আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু ওই বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এরপর ২০২১ সালের গত ১৫ সেপ্টেম্বর ১৩ পদে ৬০ জন নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেয় চসিক। সেখানে ২০২০ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পদগুলোও রয়েছে। চসিকের অস্থায়ী কর্মচারিদের দাবির পর ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে। পরবর্তীতে ৬৫০ এর অধিক শূন্যপদ অস্থায়ীদের দিয়ে পূরণ করা হয়।
এর আগে ৪১ ক্যাটাগরির বিভিন্ন পদে নিয়োগে ২০১৮ সালের ১০ মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একই বছরের জুন মাসে তা বাতিলের নির্দেশ দেন।
অতঃপর উদ্যোগ নেন ডা. শাহাদাত : মেয়র পদে দায়িত্ব নেয়ার পর চসিকের জনবল কাঠামো’তে শৃক্সখলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন ডা. শাহাদাত হোসেন। এর অংশ হিসেবে অস্থায়ীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে স্থায়ীকরণের পাশাপাশি শূন্যপদ পূরণে পদক্ষেপ নেয় চসিক। এক্ষেত্রে নিয়ম মানার পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিতে গত ৭ এপ্রিল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ৩০ এপ্রিল ছিল অনলাইনে আবেদন জমার শেষ দিন।
পরবর্তীতে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষাগ্রহণ করতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা চায় চসিক। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ জন্য প্রায় ২ কোটি টাকা দাবি করে। সর্বশেষ প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় এ কার্যক্রম সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয় চসিক।
সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, কর্পোরেশনকে এগিয়ে নিতে এবং নগরবাসীর সেবা নিশ্চিতে যোগ্য জনবল দরকার। তাই নিয়োগের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নিয়োগ দেয়া হবে। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা হবে।
চসিকের সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন আজাদীকে বলেন, ১০ অক্টোবর থেকে পরীক্ষা নেয়া শুরু হবে। আশা করছি এক মাসের মধ্যে পরীক্ষা সম্পন্ন হবে। এ নিয়োগ পরীক্ষা শতভাগ স্বচ্ছ হবে।
কোন পদের বিপরীতে কয়জন প্রার্থী : একটি সহকারী এস্টেট অফিসার পদের বিপরীত আবেদন করেছেন ৮৩৫ জন। এছাড়া তিনটি উপ–সহকারী প্রকৌশলী (পুর) বিপরীতে আবেদন করেছেন ১ হাজার ৩১৭ জন। অর্থাৎ উপ–সহকারী প্রকৌশলীর (পুর) প্রতি পদের বিপরীতে প্রার্থী ৪৩৯ জন। পাঁচটি ড্রাফটসম্যান পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৯৪২ জন। অর্থাৎ প্রতিটি ড্রাফটসম্যান পদের বিপরীতে প্রার্থী ১৮৮ জন।
৪টি ফোরম্যান পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ২৬৭৮ জন। অর্থাৎ প্রতিটি ফোরম্যান পদের বিপরীতে প্রাথী ৬৬৯ জন।
একটি প্রটোকল সহকারী পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৩৬০ জন। একটি সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৪৮৭ জন। একটি সহকারী কোষাধ্যক্ষ পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ২২৬ জন। একটি পোদ্দার পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ২২৬ জন। একটি নথি সহকারী পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ১৫৭ জন। একটি নকলনবীশ পদে বিপরীতে আবেদন করেছেন ৭৩ জন। একটি ভান্ডার সহকারী পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৯৫ জন।
১০টি পরিদর্শক (মশক নিয়ন্ত্রণ) পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৫ হাজার ৩২৩ জন। অর্থাৎ প্রতিটি পরিদর্শক (মশক নিয়ন্ত্রণ) পদের বিপরীতে প্রাথী ৫৩২ জন।
ছয়টি ট্রেসার পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ১৬৭ জন। অর্থাৎ প্রতিটি ট্রেসার পদের বিপরীতে প্রার্থী ২৭ জন। ছয়টি যানবাহন পরিদর্শক পদের বিপরীত আবেদন করেছেন ১ হাজার ৪৭৯ জন। প্রতিটি যানবাহন পরিদর্শক পদের বিপরীতে প্রার্থী ২৪৬ জন। ২৩টি ওয়ার্ড সেক্রেটারি পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৯ হাজার ৫৫৩ জন। অর্থাৎ প্রতিটি ওয়ার্ড সেক্রেটারি পদের বিপরীতে প্রার্থী ৪১৫ জন।
১০টি ক্রোকী অফিসার (ওয়ারেন্ট অফিসার) এর বিপরীতে আবেদন করেছেন ৪ হাজার ৭৩৪ জন। অর্থাৎ প্রতিটি ক্রোকী অফিসার (ওয়ারেন্ট অফিসার) এর বিপরীতে প্রার্থী ৪৭৩ জন।
১১টি সার্ভেয়ার পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ১ হাজার ৯১ জন। অর্থাৎ প্রতিটি সার্ভেয়ার পদের বিপরীতে প্রার্থী ৯৯ জন। আটটি দলপতি পদের বিপরীতের আবেদন করেছেন ১ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ প্রতিটি দলপতি পদের বিপরীতে প্রার্থী ১৫৮ জন।
দুইটি নথি রক্ষক পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ২৭১ জন। অর্থাৎ প্রতিটি নথি রক্ষক পদের বিপরীতে প্রার্থী ১৩৫ জন। ছয়টি সহকারী স্টোর কিপার পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৮১১ জন। অর্থাৎ প্রতিটি সহকারী স্টোর কিপার পদের বিপরীতে প্রার্থী ১৩৫ জন।
১৯টি স্বাস্থ্য সহকারী পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৩ হাজার ৫০ জন। অর্থাৎ প্রতিটি স্বাস্থ্য সহকারী পদের বিপরীতে প্রার্থী আছেন ১৬০ জন। এছাড়া দুইটি বাজার পরিদর্শক পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৬৮৩ জন। অর্থাৎ একটি বাজার পরিদর্শক পদের বিপরীতে প্রার্থী আছেন ৩৪১ জন।
চসিকের সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চসিকে সাড়ে ৮ হাজারের বেশি জনবল কর্মরত। সংস্থাটি বর্তমানে ১৯৮৮ সালের জনবল কাঠামো ধারা পরিচালিত হয়। এতে সৃজিত পদের সংখ্যা ৩ হাজার ১৮০ জন। এছাড়া ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে এক হাজার ৪৬ নতুন পদ সৃষ্টির অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালের ডিসম্বরে বিভিন্ন ক্যাটাগরির এক হাজার ১৪৮টি পদে নিয়োগের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করে চসিক। পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ৬১২ পদের বিপরীতে সরাসরি ও ৫৩৬ পদে আউটসোর্সিং নীতিমালায় ছাড় দেয় মন্ত্রণালয়।