নিষ্ঠাবান এক গবেষকের বিদায়

ডা: মাহমুদ আহমেদ চৌধুরী আরজু | সোমবার , ৩১ মে, ২০২১ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

১লা মে, আনুমানিক সকাল ৯টা। ঐ দিন ছুটি থাকাতে দেরিতে উঠলাম। মোবাইল ফোন চেক করার সময় দেখলাম চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল আবুল হাসান সাহেবের মিস কল। আমি পাল্টা উনাকে কল করি। কল করলে উনি বললেন মজনু ভাইয়ের কোন খবর পেয়েছেন? শুনলাম উনি মারা গেছেন। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কারণ রোজার শুরুতে উনার সাথে আমার কথা হয়েছিলো। উনাকে আমি উনার পরিচালিত কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠানে যাকাতের টাকা দেওয়ার জন্য টেলিফোন করেছিলাম। উত্তরে উনি বলেছিলেন আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। গায়ে জ্বর ও দুর্বল লাগছে। আমি উনাকে বার বার প্রশ্ন করলাম। আপনি কোভিড-১৯ টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন কি? উনি না উত্তর দিলেন। তখন মনে একটা অজানা ভয় আমার মনে ঢুকে গিয়েছিলো। একজন হার্ট বাইপসের রোগীর জ্বর। কোভিড মহামারীতে এখনও টিকা দেয়নি। তার উপর সম্ভবত উনি কোন চিকিৎসকের পরামর্শও গ্রহণ করেননি। আমি উনাকে বলেছিলাম, আপনি মা ও শিশু হাসপাতালে এসে করোনা পরীক্ষা করান। কাজেই উনার মৃত্যুটা করোনার কারণে কিনা একজন ডাক্তার হিসেবে আমি কিছুটা সন্দেহ পোষণ করছি। যাক ঐ দিন অধ্যক্ষ সাহেবের সাথে কথা বলার পর মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু ভাইকে টেলিফোন করলাম এবং উনার সাথে কথা বলে মজনু ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদটা নিশ্চিত হলাম। চলে গেলেন মজনু ভাই সব কিছু অসমাপ্ত রেখে। আমরা হারালাম আমাদের একজন পরম শুভাকাঙ্ক্ষীকে।
সাখাওয়াত হোসেন মজনু ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘ ১৯৯৮ সাল থেকে। যখন আমার বড় আপা প্রফেসর রওশন আক্তার হানিফ চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন। সম্ভবত অধ্যক্ষের রুমেই উনার সাথে প্রথম পরিচয় হয়। বড় আপার সাথে চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদের ব্যাপারে আলাপ করছিলেন। এরপর থেকে উনার সাথে আমার যোগাযোগ বহুমাত্রিক। একজন চিকিৎসক হিসেবে উনার অনেক গরীব শিশুকে আমি বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতাম। রোটারী ক্লাব অব চিটাগাং এর মাধ্যমে বিভিন্ন এতিমখানায় ত্রাণ ও কাপড় বিতরণ করেছি। এছাড়া উনি আমার মরহুম পিতার মৃত্যু বার্ষিকীতে স্মরণ সভা করার উদ্যোগ নিতেন। উনার সহযোগিতায় আমরা অনেক স্মরণ সভা করেছি, যেখানে চট্টগ্রামের অনেক প্রবীণ গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থেকে আমার পিতা মরহুম বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর জীবনের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য অংশের আলোচনা করেছেন। মরহুম বাদশাহ মিয়া মৃত্যু বার্ষিকীতে তিনি চট্টগ্রামের আজাদী পত্রিকায় আর্টিকেল ছাপাতেন। উনার লেখায় মরহুম বাদশা মিয়া চৌধুরীর চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে অবদান সেটা প্রায় উল্লেখ করতেন। ২০২০ সালের ২রা নভেম্বর চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বদেশে “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাদশা মিয়া চৌধুরী ও সতীর্থদের অবদান” একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন। এ আর্টিকেলে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তার লেখায় উল্লেখ আছে যে, বৃটিশ সরকার চট্টগ্রাম কলেজকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিয়েছিলো। এ প্রস্তাবে স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল চট্টগ্রাম কলেজ সংলগ্ন পাহাড়গুলো, প্যারেড মাঠ, ডেপ পাহাড় ও সংলগ্ন এলাকাগুলো। এতে শিক্ষানুরাগী মহল খুশি হল। কিন্তু জমির মালিকেরা খুশি হতে পারেন নি। ফলে প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন চট্টগ্রামের ঐ সকল ভূমি মালিকেরা। শুধু নিজেদের ভূমির স্বার্থে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অনেক পরে ১৯৬০ এর শেষের দিকে চট্টগ্রাম শিক্ষানুরাগী মহল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পুনরায় সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালের ৭ই মে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ৩য় বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে স্থাপনের দাবি রাখা হয়। এতে বাদশাহ মিয়া চৌধুরী সভাপতি এবং প্রফেসর আহমদ হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। এ সময় চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে ফজলুল কবির চৌধুরী, আবুল খায়ের ছিদ্দিক, আজিজুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, অধ্যাপক এবিএম সুলতান আলম চৌধুরী, প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিপি, জিএস পৃথক পৃথক ভাবে চট্টগ্রামেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য দৈনিক আজাদীতে এক বিবৃতি দেন। তিনি তার লেখায় দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছেন যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্য, যারা জীবন সংগ্রাম করে এ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের স্মৃতি আজো বিস্তৃতির অতলে। এ ব্যাপারে পূর্বতন উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীকে অনুরোধ করেছিলেন, উত্তরে বলেছিলেন যে এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোন নথী নেই। অথচ মজনু ভাইয়ের অনেক লেখায় এমনকি দৈনিক আজাদীর প্রকাশিত হাজার বছরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ আছে। এ ব্যাপারে বর্তমান উপাচার্যকে অনুরোধ করছি উদ্যোগ নিতে।
মজনু ভাইয়ের কাছে আমি এবং আমার পরিবার কৃতজ্ঞ। তিনি আমার পিতার উপর একটি বই লিখেছেন নাম “শিক্ষা-সমাজসেবায় কিংবদন্তি বাদশাহ মিয়া”। ১৫৮ পৃষ্ঠার এই বইটিতে তিনি বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর কর্মময় জীবন সম্পর্কে তুলে ধরেছেন। এ বইটি প্রকাশের আগে আমি তাকে নিয়ে নানা জায়গায় গিয়েছি। অনেক গুনীজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ নিয়েছি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এ বই প্রকাশের জন্য তাকে অনুরোধ করেছিলেন বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি ওহিদুল আলম। তিনি বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর শৈশব কালের বন্ধু। বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর কর্মজীবন নিয়ে কবি ওহিদুল আলমের লেখা “স্মৃতির আলোকে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষাসাধক প্রিয় বন্ধু বাদশাহ মিয়া চৌধুরী” পান্ডুলিপিটি মজনু ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলেছিলেন এটি প্রকাশ করার দায়িত্ব তোমার। মজনু ভাই আমার বড় আপা রওশন আকতার হানিফ মারা যাওয়ার পর ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও অধ্যাপক মোঃ খালেদ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে স্মরণ সভা করেছিলেন এবং পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা এক লক্ষ টাকার বৃত্তি ব্যবস্থা করেছি। অসমাপ্ত রয়ে গেল তার লেখা বাদশাহ মিয়া চৌধুরী বইটির ইংরেজী সংকলন ও বড় আপা রওশন আকতার হানিফের উপর লেখা আর একটি বই। এছাড়া তিনি আমাকেও আমার বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেছিলেন।
সাখাওয়াত হোসেন মজনু ভাই ছিলেন অনেক সংগঠনের সফল উদ্যোক্তা। তবে আধিপত্য বিস্তার, আস্থাহীনতা ও ব্যক্তি স্বার্থের কারণে মজনুভাই অনেকগুলো থেকে নিজেকে নীরবে সরিয়ে নিয়েছিল। সমাজের অবহেলিত নারী ও শিশুদের জন্য তার প্রচুর অবদান রয়েছে। সমাজের বিপথগামী যুব সমাজকে সুন্দর জীবন লাভ করার জন্য তিনি পাড়ায় পাড়ায় যুব সংগঠন ও লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর বিদায়ে চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। মহান আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসীব করুন। আমিন।

লেখক : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিকাহ রেজিষ্ট্রি ও দেনমোহর প্রসঙ্গে-২
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়