শুক্রবার দুপুর ১২টা। বাঁকখালী নদীর কস্তুঘাট থেকে নুনিয়ারছড়া পর্যন্ত মোহনায় সারি সারি করে নোঙর করে রাখা হয়েছে মাছ ধরার ট্রলার। অথচ এই সময়ে সাগরে মাছ ধরায় ব্যস্ত সময় পার করার কথা ছিলো এসব ট্রলারের। কিন্তু ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটা। সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা গত ২৩ জুলাই শেষ হয়ে গেলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগরে যেতে পারেনি কক্সবাজারের মাছ ধরার ট্রলারগুলো। কিছু কিছু ট্রলার বৈরী আবহাওয়া উপক্ষো করে গেলেও তারা নানা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে বলে দাবি জেলেদের। ফলে অবরোধ শেষ হলেও দুর্যোগে আটকে আছে জেলেদের জীবন–জীবিকা।
গত ২৩ জুলাইয়ের আগে থেকেই সব মালামাল নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন জেলেরা। কিন্তু সাগরে যেতে না পারায় তারা এখন অলস সময় কাটাচ্ছেন। যে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র মাছে ভরপুর থাকার কথা ছিল সেখানে এখন পুরনো জাল মেরামতের কাজ চলছে। ট্রলারগুলোতেও চলছে মেরামতের কাজ। প্রতিদিন সাগরে যাওয়ার জন্য আসা মাঝিমাল্লারা বাসায় ফেরত যান হতাশ হয়ে। কিছু ট্রলার বাঁকখালীর কস্তুরাঘাট মোহনায় নোঙর করে রাখা হলেও অধিকাংশই প্রতিদিন নোঙর করতে যাচ্ছে বাঁকখালীর নদীর নাজিরারটেক সৈকতের মোহনায়। কারণ বৈরী আবহাওয়া কাটলেই তারা ফিরতে চান সাগরে। কিন্তু আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে কখন তাদের সুদিন ফিরবে সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটছেই না। মৎস্য অতরণ কেন্দ্রে কথা হয় জেলে মোহাম্মদ হানিফের সাথে। তিনি জানান, ৬৫ দিন বন্ধ শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা বেশ উৎফুল্ল ছিলেন। কিন্তু তাদের আশায় জল ঢেলে দেয় বৈরী আবহাওয়া। এভাবে আর কিছুদিন সাগরে যেতে না পারলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কথা হয় ইলিশ আহরণের ট্রলার এফবি আব্দুল মালেকের মাঝি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর সাথে। তার বাড়ি মহেশখালী উপজেলার ছোট মহেশখালী ইউনিয়নে। সব প্রস্তুতি নিয়ে সাগরে যেতে না পারার আক্ষেপ প্রকাশ করেন এ প্রতিবেদকের কাছে। মাঝি শহিদুল্লাহ অভিযোগ করেন, ৬৫ দিন বন্ধের সময় সরকারের বরাদ্দের চাল পাননি। তিনি বলেন, সহায়তার চাল বিতরণের খবর পেয়ে তিনি চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিয়ান সিকদার তাকে বরাদ্দের চাল দেননি। সেই সময় তাকে জানানো হয়েছিলো সরকারের তালিকা থেকে তার নাম কেটে গেছে। পরে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেন তালিকায় তার নাম রয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে ধর্ণা দিয়েও কাজ না হওয়ায় সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি। তার মতো অনেক জেলে অভিযোগ করেন, সরকারের বরাদ্দের চাল গেছে জনপ্রতিনিধিদের পেটে। একদিকে বরাদ্দের চাল লুট অন্যদিকে বৈরী আবহাওয়া, সবমিলিয়ে চরম দুর্দিন যাচ্ছে তাদের।
ট্রলার মালিক ও মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউনুস জানান, বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে যে কয়টি ট্রলার সাগরে গেছে তারা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে টেকনাফ ও কক্সবাজারে দুটি ট্রলার বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, প্রতিবছর নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার দুইদিনের মধ্যেই অবতরণ কেন্দ্রে মাছ খালাস করে অনেক ট্রলার। কিন্তু এববছর এখনো অবতরণ কেন্দ্রে প্রাণ ফেরার কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রমিক, ব্যবসায়ী সবাই কখন মাছ নিয়ে ট্রলারগুলো ঘাটে ভিড়বে সেই আশায় বসে আছে।
কক্সবাজার জেলায় সাড়ে ৫ হাজার ছোট ও মাঝারি সাইজের মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে। সরকারি হিসেব মতে, নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৫ হাজারের মতো। সাগরে মাছ ধরে এসব ট্রলারের অধিকাংশই মাছ খালাস করে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। কিন্তু সেখানে এখন মাছের দেখা নেই।
কক্সবাজার জেলা বোট মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক মুকুল বলেন, বৈরী আবহাওয়াসহ নানা কারণে গেল বছরও তাদের লোকসান হয়েছে। এ বছরও শুরুতে বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ায় লোকসানের আশঙ্কা করছেন তিনি। মুকুল বলেন, এই ধরনের বৈরী আবহাওয়া চলতে থাকলে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। একই সাথে বোট মালিক, মাঝিমাল্লাসহ সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের হিসাব মতে, কক্সবজারে গেল ২০২৩–২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৮ হাজার মেট্রিক টন থাকলেও আহরণ হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৮৫০ মেট্রিক টন। সেকারণে চলতি অর্থবছরে (২০২৪–২৫) লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়েছে ৭ হাজার মেট্রিক টনে। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে এই টার্গেট পূরণেও শঙ্কা রয়েছেন বলে জানান বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক জিএম রব্বানী।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০২১–২২ অর্থবছরে কক্সবাজারে মাছ আহরণ হয়েছে ৭২১১ মেট্রিক টন, ২০২২–২৩ অর্থবছরে আহরণ হয় ৮১০০ মেট্রিক টন। কিন্তু সেই আহরণের পরিমাণ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে নেমে আসে ৫৮৫০ মেট্রিক টনে। যা লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ।