চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও জেলা প্রশাসন নগরকে পলিথিনমুক্ত করতে একসঙ্গে কাজ করবে। এক্ষেত্রে আগামী দুই মাস পলিথিনবিরোধী প্রচারণা চালানো হবে। এরপর শুরু হবে অভিযান। গত ২ মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে খবরটি জানা যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযানে বাজারে কোনো দোকানদার বা ব্যবসায়ীর কাছে পলিথিন পাওয়া গেলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে অভিযানে বেশি জোর দেয়া হবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ যেসব কারখানায় পলিথিন উৎপাদন হয় সেখানেই অভিযান চালানো হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বর্তমান পর্ষদের ২৭তম সাধারণ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্দরকিল্লা নগর ভবনের কেবি আবদুস সাত্তার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এতে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
পলিথিনবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি ফুটপাত দখলমুক্ত করা এবং জলাধার রক্ষাসহ বিভিন্ন নাগরিক ইস্যুতে চসিক ও জেলা প্রশাসন একসাথে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এই দুই সংস্থার প্রধান। মেগা প্রকল্পের আওতায় খালে দেয়া বাঁধ অপসারণ হয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে চসিক, সিডিএ ও জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় পরিদর্শনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় সিডিএর কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।
পরিবেশ সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার যেমন শেষ নেই, তেমনিভাবে প্রচার–প্রচারণা ও গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব উপাদানকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। পলিথিন পরিবেশ সুরক্ষার জন্য চরম হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ।
একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, আমাদের দেশে দিন দিন পলিথিনের ব্যবহার বেড়েই চলেছে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। আশির দশকে প্রথম দেশের বাজারে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয়। এখন পাইকারি বিক্রয়সহ প্রায় সব হাটবাজারেই অবাধে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ সহজলভ্য ও এর দাম কম হওয়ায় দোকানিরাও যথেচ্ছভাবে সেগুলো ব্যবহার করে চলেছেন। একবার ব্যবহারের পর সেগুলো যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে। অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগর–মহানগরের পয়ঃনিষ্কাশনের নালা–নর্দমা। ভেঙ্গে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পলিথিন বর্জ্যের কারণে বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। ভরাট হচ্ছে খাল–বিল–নদী, দূষিত হচ্ছে পানি। পলিথিন খাল–বিল, নদী–নালায় জমা হয়ে তলদেশ ভরাট করে ফেলে। নাব্য নষ্ট হওয়ায় নৌপরিবহনে বিঘ্ন ঘটে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হয়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পানিবদ্ধতা। দুর্ভোগের শিকার হয় নগরবাসী।
পরিবেশবিদদের মতে, ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় পলিথিন তৈরিতে। পলিথিন মাটির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পচনশীল না হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করে সব ধরনের চাষাবাদে। পলিথিন মাটির অভ্যন্তরে চলে যাওয়ার ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মাটির নিচেও তা পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে, মাটির গুণগত মান ও ঊর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় শস্যের উৎপাদন কমে যায়। মাটির নিচের পলিথিনের কারণে গাছ খাবার পায় না। এ কারণে গাছ কম আক্সিজেনের উৎপাদন করায় বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড, সীসা এসবের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের স্বল্পতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে হাঁপানি কিংবা শ্বাসরোগ বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জনসাধারণ সচেতন হলেই কমানো যায় পলিথিনের ব্যবহার, রক্ষা পায় আমাদের পরিবেশ ও শত শত মানুষ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করে ২০০২ সালে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫’–এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন ও পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেইসঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসেই জেলসহ ১০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাজারগুলোয় প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হলেও এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই।
কঠোর নির্দেশনার ফলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৯০ শতাংশ লোক পাটের ব্যাগ ব্যবহার করছে, কিন্তু আমাদের দেশে আইন প্রয়োগের অভাবে নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন এখনও হচ্ছে। নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ বন্ধ করতে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যেন কেউ পলিথিন উৎপাদন না করে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ বা ঠোঙা রয়েছে। এগুলো সহজলভ্য করতে হবে। দেশে কোনোভাবেই যেন নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদিত না হয়, সেদিকে সরকারকে কড়া নজর দিতে হবে এবং পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে প্রচার বাড়াতে হবে।