নগর জুড়ে চলছে ‘নিলাম’ লেখা এবং ‘চট্টগ্রাম’ ও ‘প্রাইভেট’ নিবন্ধিত সিএনজি টেক্সি। মোটরযান আইন অনুযায়ী বিআরটিএ হতে নিবন্ধন ব্যতিরেকে কোন গাড়ি রাস্তায় চলাচলের সুযোগ নেই। এক জোনে নিবন্ধিত সিএনজি টেক্সিও অন্য জোনে চলাচলের সুযোগ নেই। ব্যক্তিগত (প্রাইভেট) নিবন্ধিত গাড়ির বাণিজ্যিক চলাচলেরও সুযোগ নেই। মহানগরীতে নিবন্ধিত গাড়ির মতো করেই সিকিউরিটি নেট (লোহার ঝাঁপ) লাগিয়ে সাধারণ যাত্রীদের সাথে প্রতারণা করে যাত্রী বহন করছে এসব অবৈধ সিএনজি টেক্সি। অভিযোগ রয়েছে, ট্রাফিক পুলিশকে মাসোহারার মাধ্যমে নগরীতে চলাচল করছে এ ধরনের কয়েক হাজার অবৈধ সিএনজি টেক্সি। রয়েছে যাত্রীদের সাথে প্রতারণার অভিযোগও।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সোমবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নগরীর মূল সড়কে ‘চট্টগ্রাম’ নিবন্ধিত অটোরিকশা চালানোর সুযোগ নেই। পুলিশের পক্ষ থেকে সবসময় গাড়িগুলো আটক করা হয়। তবে নিলামে নেওয়া অটোরিকশা চলাচলের বিষয়টি প্রথম শুনছি।’ এসব অবৈধ গাড়ি চলাচলে পুলিশকে মাসোহারার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢালাও অভিযোগ করা হলে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। অনিয়মের সাথে জড়িত থাকলে আমার কোন পুলিশ সদস্যকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমি তাদের (পুলিশ সদস্য) এই ম্যাসেজ দিয়ে দিয়েছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানা যায়, বিভিন্ন মামলার আলামত হিসেবে জব্দকৃত সিএনজি অটোরিকশা অনেক সময় স্ক্র্যাপ হিসেবে নিলামে বিক্রি হয়। আদালত থেকে নিলামে এসব অটোরিকশা ক্রয় করে গাড়িতে ‘নিলামে ক্রয়কৃত’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে বিআরটিএ থেকে কোন প্রকার নিবন্ধন ব্যতিরেকে নগরীতে চলাচল করছে অসংখ্য অটোরিকশা। আবার চট্টগ্রাম জেলা জোনে নিবন্ধিত অটোরিকশা সিকিউরিটি নেট লাগিয়ে মহানগরী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন জেলা থেকে বেআইনিভাবে আসা প্রাইভেট নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা নগরীতে চলাচল করছে অহরহ। এ ধরনের বেশিরভাগ গাড়িতে কোন কাগজপত্রও থাকে না। সবগুলোই চলে পুলিশি মাসোহারার মাধ্যমে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগে কিছু ট্রাফিক সার্জেন্ট ও টিআই টোকেন দিয়ে মাসোহারা তুললেও এখন কোন টোকেন দেওয়া হয় না। সবকিছুই হয় মোবাইল ম্যাসেজে। মাসোহারায় চলাচলকারী গাড়ির নম্বর যেমন সংশ্লিষ্ট সার্জেন্ট এবং টিআইয়ের কাছে থাকে, তেমনি গাড়িটির চালক ও মালিকের কাছেও থাকে ওই ট্রাফিক কিংবা টিআইয়ের মুঠোফোন নম্বর। এভাবে মাসের পর মাস নগরজুড়ে চলাচল করছে কয়েক হাজার অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা।
নগরীর টাইগারপাস মোড় থেকে দ্রুতগতিতে আগ্রাবাদের দিকে ছুটছে ‘চট্টমেট্রো-থ-১১-৫৩৭১’ নম্বর লেখা অটোরিকশা। এটিও সিকিউরিটি নেট সাঁটানো। গাড়িটিকে লক্ষ্য করে দেওয়ানহাট মোড়ের দিকে গেলে দেখা যায়, ‘অটোরিকশাটিতে ডিজিটাল নম্বর প্লেট না থাকলেও পেছনে ‘রাকিব সাকিব সজিব এঙঃ’ লেখা রয়েছে। ওই নামের নীচের দিকে লেখা রয়েছে ‘নিলাম ক্রয় জিডি নং ৭৪৪’। নিলাম ক্রয় শব্দটি লেখার পাশাপাশি গাড়িটির নম্বর দেখে সন্দেহ তৈরি হলে যোগাযোগ করা হয় বিআরটিএতে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে গাড়িটির মেয়াদ ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১৮ সালে ‘চট্টমেট্রো-থ-১১-৫৩৭১’ নম্বরের গাড়িটি বিআরটিএতে সারেন্ডার করে নতুন গাড়ির নিবন্ধন নেয় গাড়িটির মালিক। গাড়িটির অনুকুলে চট্টমেট্রো-থ-১২-৮০৭৭’ নতুন নম্বর দেওয়া হয়। এ বিষয়ে বিআরটিএ চট্টগ্রাম মেট্রো সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি) তোহিদুল ইসলাম রোববার বিকেলে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘চট্টমেট্রো-থ-১১-৫৩৭১’ নম্বরের অটোরিকশাটি চট্টগ্রাম বিআরটিএ কার্যালয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। এরপর গাড়ির মালিকের অনুকূলে নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। কেউ নম্বরটি ব্যবহার করে অন্য কোন গাড়ি চালালে তা প্রতারণার শামিল হবে।’
একইভাবে দুই দিন আগে চেরাগি পাহাড় মোড়ে দেখা মেলে ‘নিলামে ক্রয়কৃত, মামলা নং ৪(৯)১২’ অটোরিকশার। পেছনে মামলা নম্বর লেখাটির নীচে লেখা আছে ‘মা-বাবার দোয়া’। কোন প্রকার নিবন্ধন ছাড়াই চলছে গাড়িটি। বক্তব্য জানতে সোমবার সন্ধ্যায় গাড়িটির একপাশে লেখা মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি নিজেকে সেলিম পরিচয়ে প্রতিবেদককে বলেন, ‘গাড়িটি আমার ওয়াইফের (স্ত্রী) নামে। আমার ভাই দেখভাল করে। কিভাবে চলে জানি না।’
অন্যদিকে লালখান বাজার থেকে জিইসি মোড়ের দিকে যাচ্ছিল ‘চট্টগ্রাম-থ-১৪-৬৪৯৯’ নম্বরের অটোরিকশা। মহানগরীতে নিবন্ধিত অটোরিকশার আদলে গাড়িটিতে লোহার সিকিউরিটি নেট লাগানো। অটোরিকশাটির পেছনে বাংলায় বড় করে লেখা ‘সার্জান হাসান’। গাড়িটি যাত্রী নেওয়ার জন্য ওয়াসার মোড়ে দাঁড়ালে কথা হয় চালকের সাথে। রফিক নামের ওই চালক জানান, ‘এটি সার্জেন্ট হাসানের গাড়ি। আমি আজকে গাড়ি নিয়ে নেমেছি।’ অটোরিকশার একপাশে সার্জেন্ট হাসানের ব্যবহৃত মুঠোফোনের নাম্বারও লেখা রয়েছে। কয়েকদিন আগের ঘটনা হলেও সোমবার সন্ধ্যায় ওই অটোরিকশায় লেখা মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি নিজেকে সার্জেন্ট হাসান বলে স্বীকার করেন। গাড়িটির বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক সার্জেন্ট হাসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমার নামে নগরীতে কোন গাড়ি চলে না। গাড়িতে আমার নাম লেখা থাকলে আমি গাড়িটি আটক করবো।’ এসময় মুঠোফোনে ওই অটোরিকশার অবস্থান জানতে চান সার্জেন্ট হাসান।
এর কয়েকদিন আগে একই কায়দায় নগরীতে চলাচলকারী ‘চট্টগ্রাম-থ-১২-৫২০১’ নম্বরের অটোরিকশাটিকে দেখা যায় নগরীর লালদীঘি মোড়ে। গাড়িটির দ্রুতগতি থাকার কারণে চালকের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে গাড়িটির একপাশে লেখা রয়েছে ‘মালিক পুলিশ কনস্টেবল রতন’। পাশে লেখা রয়েছে মুঠোফোন নম্বরও। বক্তব্য জানতে ফোন করা হলে মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
তাছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরী জুড়ে কয়েক হাজার প্রাইভেট অটোরিকশা চলাচল করে। অভিযোগ রয়েছে, রেজিস্ট্রেশনের শর্ত ভঙ্গ করে প্রাইভেট নিবন্ধিত এসব অটোরিকশা বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী বহন করছে পুলিশকে ম্যানেজ করেই। তাছাড়া অন্য জেলায় নিবন্ধিত অসংখ্য প্রাইভেট অটোরিকশা চলাচল করে চট্টগ্রাম মহানগরীতে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ২০ মার্চ ‘ফেনী-দ-১১-০০৫০’ নম্বরের গাড়িটি মুরাদপুর এলাকা থেকে আটক করে সার্জেন্ট রুহুল আমিন। গাড়িটির ডিজিটাল নাম্বারপ্লেট থাকলেও রেজিস্ট্রেশন সনদ, ফিটনেস সনদ, ট্যাঙটোকেন, ইন্সুরেন্স ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না পেয়ে তিনি আটক করে ওইদিন মনসুরাবাদ ডাম্পিং স্টেশনে পাঠান। অভিযোগ রয়েছে, কোন প্রকার বৈধ কাগজপত্র জমা ছাড়াই করোনাকালীন সাধারণ ছুটির মধ্যে ২ এপ্রিল গাড়িটি ট্রাফিক (উত্তর) এর কার্যালয় থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খোকন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নগরীতে চট্টগ্রাম নিবন্ধিত, নিলামে ক্রয় ও প্রাইভেট অটোরিকশাগুলো অবৈধভাবে যাত্রীবহন করছে। চট্টমেট্রো নিবন্ধিত অটোরিকশার মতো লোহার নেট লাগিয়ে যাত্রীদের সাথে গাড়িগুলো প্রতারণা করছে। এতে বৈধগাড়িগুলোর মালিক-শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নগরীতে এ ধরণের হাজারের অধিক গাড়ি চলছে ট্রাফিক পুলিশকে মাসোহারা দিয়েই।’ তিনি বলেন, ‘আগে ট্রাফিক সার্জেন্টরা মাসোহারার টোকেন দিতো। এখন সব হয় মোবাইল ম্যাসেজে। কোন সার্জেন্ট ধরলে মাসোহারা নেওয়া সার্জেন্ট কিংবা টিআইয়ের সাথে কথা বলিয়ে দিলে অবৈধ গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। এভাবে এক ট্রাফিক অফিসার অন্য ট্রাফিক অফিসারের নামে চলা গাড়ি ছেড়ে দেয়।’
অন্যদিকে বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ সোমবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নিবন্ধন ছাড়া যেকোন গাড়িই সড়কে চলাচল অবৈধ। আবার এক জেলায় নিবন্ধন নেওয়া অটোরিকশার অন্য জেলা কিংবা মহানগরীতে চলাচলও অবৈধ। প্রাইভেট গাড়িও বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী বহন করতে পারে না। এ ধরণের অভিযোগগুরো আমরা যখনই পাই ভ্রাম্যামান আদালতের মাধ্যমে পদক্ষেপ নিই। তাছাড়া নগরীতে পুলিশ বিভাগও অভিযান চালিয়ে থাকে।’