নির্বাচনে কোন দল কত শতাংশ ভোট পেতে পারে

সানেম ও একশনএইডের জরিপ

| মঙ্গলবার , ৮ জুলাই, ২০২৫ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলবিএনপি ৩৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভোট পেতে পারে। তাদের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১ দশমিক ৪৫ শতাংশ ভোট পেতে পারে জামায়াতে ইসলামী। তরুণতরুণীদের ওপর পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফলে এ চিত্র উঠে এসেছে। অ্যাকশনএইডের সহযোগিতায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এ জরিপ চালিয়েছে।

গতকাল সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পর এ বছর গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পেতে পারে ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট, অন্য ধর্মীয় দলগুলো পেতে পারে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোট। জাতীয় পার্টি পেতে পারে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং অন্যান্য দল পেতে পারে শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ ভোট। নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি পেলে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ পেতে পারে ১৫ দশমিক ০২ শতাংশ ভোট।

১৫৩৫ বছর বয়সী তরুণতরুণীদের অংশগ্রহণে ‘যুব জরিপ ২০২৫’ শীর্ষক এ সমীক্ষায় সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে এটি সারাদেশের আটটি বিভাগজুড়ে দুই হাজার তিনটি পরিবারে পরিচালিত হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে ৪০ শতাংশ, এসএসসি বা এর ওপরে ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে শহরের ছিল ৫০ শতাংশ এবং গ্রামের ৫০ শতাংশ। জরিপ পরিচালিত হয়েছে মূলত তরুণ জনগোষ্ঠীর বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন ও চাকরির বাজারে তাদের প্রস্তুতি নিয়ে তাদের নিজস্ব ধারণা বিশ্লেষণ করা। এছাড়া জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে তরুণরা রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের গতিপথ, অন্তর্ভুক্তি ও কার্যকারিতা সম্পর্কে কীভাবে চিন্তা করছে, সেটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। খবর বাংলানিউজের।

নির্বাচন নিয়ে আস্থাঅনাস্থা

দেশের তরুণদের মধ্যে ৯৩ দশমিক ৯৬ শতাংশই আশাবাদী যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। তবে ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ ইতোমধ্যেই নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ৭৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ তরুণ, অন্যদিকে ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ তরুণ ভোট দিতে অনাগ্রহী।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিএনপির প্রতি পুরুষ ভোটারদের সমর্থন নারীদের তুলনায় একটু বেশি (পুরুষ ৪০ দশমিক ০৩%, নারী কম)। জামায়াতের ক্ষেত্রেও পুরুষ সমর্থন বেশি (২২ দশমিক ৫১%) নারীর তুলনায় (২০ দশমিক ৫৭%)। অন্যদিকে, এনসিপির প্রতি নারীদের সমর্থন পুরুষদের চেয়ে বেশি, এবং শহরাঞ্চলে এই দলের জনপ্রিয়তা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি।

রাজনীতি ও সংস্কার

জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী রাজনীতি ও সংস্কার নিয়ে তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি এ জরিপে তুলে ধরা হয়েছে। রাজনৈতিক সচেতনতার দিক থেকে দেখা যায়, মাত্র ২৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ তরুণ নিয়মিত রাজনীতি অনুসরণ করে, ৩৯ দশমিক ০৯ শতাংশ মাঝে মাঝে করে, আর ৩৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ একেবারেই আগ্রহী না। নারীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ জাতীয় রাজনীতিতে আগ্রহী না, যেখানে পুরুষদের মধ্যে এ হার ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

ঘনিষ্ঠভাবে রাজনীতি অনুসরণকারী তরুণের হারও খুব কমপুরুষদের মধ্যে ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ ও নারীদের মধ্যে মাত্র ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই চিত্র। পুরুষদের মধ্যে ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ ও নারীদের মধ্যে ১৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ একেবারে অনবগত, যেখানে মাত্র ৯ দশমিক ১২ শতাংশ পুরুষ ও ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ নারী এই বিষয়ে ভালোভাবে অবগত।

রাজনৈতিক দলের কার্যকারিতা নিয়ে তরুণদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি স্পষ্ট। মাত্র ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা দেশের প্রকৃত সমস্যা প্রতিফলিত করে, যেখানে ৪৯ দশমিক ৪২ শতাংশ একেবারেই এ বিষয়ে একমত নন। অর্ধেক তরুণ (৫০ দশমিক ১ শতাংশ) মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সঙ্গে কোনো সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি, আর বিপরীতে মাত্র ১৬ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ মনে করেন যে দলগুলো তরুণদের সঙ্গে যুক্ত।

রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়েও তরুণদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ মনে করেন সংস্কার ছাড়াই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। তবে ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ বিশ্বাস করেন, যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। অপরদিকে, ১১ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ ভবিষ্যতে পরিস্থিতির আরও অবনতি দেখছেন এবং ১৩ দশমিক ১ শতাংশ মনে করেন, কিছুই পরিবর্তন হবে না।

এই পরিস্থিতির প্রতিফলন দেখা যায় রাজনীতিতে ভবিষ্যতে অংশগ্রহণ নিয়ে তরুণদের মনোভাবেও। ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ কোনোভাবেই রাজনীতিতে যুক্ত হতে আগ্রহী নন। ১১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণের মধ্যে কিছুটা আগ্রহ আছে এবং মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ বর্তমানে কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন।

রাজনীতি নিয়ে প্রত্যাশা

রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিয়ে তরুণদের প্রত্যাশা অনেকটাই আদর্শভিত্তিক। ৬০ শতাংশ তরুণ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন যে তারা পৃষ্ঠপোষকতা, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক সহিংসতা দূর করবে। ৫৪ শতাংশ চায় নিয়মিত নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক। পাশাপাশি, ৪৮ দশমিক ২৩ শতাংশ তরুণ মনে করেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত নয়। যারা এর বিপক্ষে, তাদের মধ্যে ৮৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ অমুসলিম, আর যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সমর্থন করেন, তাদের মধ্যে মাত্র ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ অমুসলিম।

চাকরির বাজার ও সম্ভাবনা

নির্বাচন ও ভোট নিয়ে করা জরিপ ছাড়াও সানেম তাদের চাকরির বাজার সম্পর্কে তরুণদের উপলব্ধি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে। এতে দেখা যায়, চাকরির বাজার সম্পর্কে তরুণদের উপলব্ধি বেশ গভীর। তরুণদেরকে শিক্ষা কতটা চাকরির জন্য প্রস্তুত করেছেএমন প্রশ্নে মাত্র ১৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ নিজেদের ভালোভাবে প্রস্তুত মনে করেছে, অন্যদিকে ৩০ দশমিক ৭৮ শতাংশ মনে করে তাদের শিক্ষার চাকরির প্রস্তুতিতে কোনো অবদানই নেই। ক্যারিয়ার চাহিদার ক্ষেত্রে, ৩৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ সরকারি চাকরিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, আর ২৬ দশমিক ৪১ শতাংশ উদ্যোক্তা হতে চায়। লিঙ্গভিত্তিকভাবে দেখা গেছে, নারীদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৭৫ শতাংশ সরকারি চাকরিকে পছন্দ করে, যেখানে পুরুষদের মধ্যে এই হার ৩২ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

চাকরি খোঁজার সময়কালও হতাশাজনক ২৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ দুই বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি খুঁজছেন, আর মাত্র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ গত এক মাসে খোঁজা শুরু করেছেন। যারা গত এক বছরে অন্তত একটি চাকরির জন্য আবেদন করেছে, তাদের মধ্যে ৪৫ দশমিক ১২ শতাংশ কখনোই সাক্ষাৎকার কল পাননি। প্রশিক্ষণের দিক থেকে, মাত্র ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ গত এক বছরে কোনো প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, যার মধ্যে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। খুব কম শতাংশ তরুণের বেসিক ইমেইল লেখা, কম্পিউটারে চিঠি ড্রাফট করার যোগ্যতা কিংবা আপডেটেড সিভি নেই।

এ জরিপে চাকরির বাজারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কেও তথ্য মেলে। দেখা গেছে, চাকরির বাজারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ৫৪ দশমিক ৭২ শতাংশ তরুণ ঘুষ ও স্বজনপ্রীতিকে চিহ্নিত করেছে। এরপর রয়েছে পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব (৫২ দশমিক ৬৭%), চাকরির সুযোগের স্বল্পতা (৫০ দশমিক ০২%) এবং শিক্ষার সাথে চাকরির বাজারের অসামঞ্জস্য (৪৯ দশমিক ৩৮%)। জরিপের সঙ্গে থাকা কেস স্টাডিগুলো এ বাস্তবতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলেএকজন মাস্টার্সধারী স্কুল শিক্ষিকা ও সিঙ্গেল মাদার মাসে মাত্র ৫০০০ টাকার কম আয় করেন। আর ঝালকাঠির এক ৩০ বছর বয়সী তরুণ ফ্রিল্যান্সার জানিয়েছেন, তিনি চাকরির আবেদন বন্ধ করে দিয়েছেন কারণ তিনি জানেন, ঘুষ ছাড়া চাকরি পাওয়া সম্ভব না।

বিদেশে চাকরি, দেশে থাকার প্রবণতা

আন্তর্জাতিক অভিবাসন নিয়েও জরিপ করেছে সানেম ও অ্যাকশন এইড। এতে দেখা যায়, ১ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ বিদেশে কাজ করে দেশে ফিরে এসেছেন এবং তাদের মধ্যে ৭২ দশমিক ৭৩ শতাংশ আবার যেতে আগ্রহী। যারা কখনো বিদেশে যায়নি, তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ বিদেশ যেতে চায়, আর ৫৭ দশমিক ৩ শতাংশ দেশে থেকেই কিছু করতে চায়। যারা দেশে থাকতে চায়, তাদের মধ্যে নারীর হার ৭০ দশমিক ৫৭ শতাংশ, আর পুরুষের ৪৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বিদেশে যাওয়ার প্রধান মোটিভেশন্ত উচ্চ বেতন, ভালো সুযোগসুবিধা, আর উন্নত জীবনযাত্রার প্রত্যাশা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিভাগে ভারী বৃষ্টি ও পাহাড় ধসের শঙ্কা
পরবর্তী নিবন্ধইপিজেডে লরির ধাক্কায় বাইক আরোহী কলেজ ছাত্রের মৃত্যু