নির্বাচনের ডামাডোলে নজরুল

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | শুক্রবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৯:৪০ পূর্বাহ্ণ

ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে জন্ম নেয়া কবি নজরুল বিশ শতকীয় অবিভক্ত ভারতের উত্তাল স্রোত, রাজনৈতিক উন্মাদনার সঙ্গে ধর্মীয় বিভাজনের যে বিক্ষুব্ধ চিত্র তাঁকে কেন্দ্র করে নিজেকে তৈরি করেছেন। তিনি প্রতিকূল বলয়ের একজন সৃজন বোদ্ধাও বটে। ঔপনিবেশিক শাসন শোষণে লাঞ্ছিত মানবতার লড়াকু সৈনিকের স্থানটি দখলও করেছেন। শৈশবকৈশোর অতিক্রান্তের দুঃসময়ে এমন কণ্টকাকীর্ণ যাত্রাপথ সুস্থির ও নির্বিঘ্ন ছিল না। সৃজনশীল দ্যোতনায় নিজস্ব অভিগমনকে অবারিত করতে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে যে দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু করলেন, সেটাও যেন এক অবাক বিস্ময়ের পালাক্রম।

আপন ঐতিহ্যিক ধারায় কৃষ্টি সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করে সৃষ্টির উন্মাদনায় যা দিলেন সেটা আজ অবধি বাংলা সাহিত্যের নব সৃষ্টির জোয়ার। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। মূলত নজরুল অল্প সময়েই কালজয়ী কবিতা, অসামান্য গান, সমাজ ও রাজনীতি সচেতন গল্প, স্বাধিকারবোধের নাটক, জীবন খেয়ালি উপন্যাস, সাহিত্যকৃতি জাগরণের প্রবন্ধসবর্ত্র বিচরণ করেছেন।

প্রতিভাধর নজরুল অনুপম সৃজন শৈলীতে নিমগ্ন হওয়ার সময় পেয়েছিলেন মাত্র ২২ বছর। কিন্তু এত অল্প সময়ে আপামর বাঙালিকে যে সম্পদ উপহার দিলেন তা আজও এক অনন্য সৃষ্টি সম্ভার। দাপটের সঙ্গে সৃজন সৌধকে অবারিত করতে সমকালীন সার্বিক ধারাকে যেভাবে অতিক্রম করলেন তাও এক অসাধারণ সৃষ্টির উন্মাদনা। নিজেকে যথার্থ আসনে বসানোই শুধু নয়, উপস্থিত সময়েরও এক নান্দনিক দ্যোতনা। যা কাল ও যুগের সীমানা অতিক্রম করে অজেয়, অম্লান, দ্যুতিময় জগত আজও সবাইকে উদ্দীপ্ত চেতনায় মাতিয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম একবার নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। ভোট চাইতে ঘুরে বেড়িয়েছিন দ্বারে দ্বারে।

১৯২৬ সালের কথা। ওই বছরের শেষ দিকে “ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইনসভা” নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কাজী নজরুল ইসলাম তখন সারা বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি। ঢাকা বিভাগ থেকে আইনসভায় দুজন মুসলিম প্রতিনিধির কোটা ছিল। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস সমর্থিত স্বরাজ দলের প্রার্থী হন কাজী নজরুল ইসলাম।

বর্তমান ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ নিয়ে গঠিত একটি আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।

কবির ধারণা ছিল, বাংলার মানুষ যেভাবে তাকে ও তার কবিতাকে যেভাবে ভালোবাসে, তাতে নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।

ফরিদপুরের এক জনসভায় কবি জসীমউদ্‌দীনকে তিনি বলেছিলেন, ‘জসীম, তুমি ভেবো না। নিশ্চয়ই সবাই আমাকে ভোট দেবে। ঢাকায় আমি শতকরা ৯৯টি ভোট পাব। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি কিছু পাই, তাহলেই কেল্লাফতে। নির্বাচিত আমি তো হবই; নির্বাচিত হলে মাঝে মাঝে আমাকে দিল্লি যেতে হবে। তখন তোমরা কেউ কেউ আমার সঙ্গে যাবে।’

কিন্তু ভোটের মাঠে নেমেই বদলে যেতে থাকে কবির অভিজ্ঞতা। কারণ, রাজনীতি আর ভোটের হিসাব তো ভিন্ন। কাজ করতে গিয়ে প্রথমেই খরচ নিয়ে বিপাকে পড়েন বিদ্রোহী কবি। নির্বাচন করতে কেমন টাকা লাগে, সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণা ছিল না। পার্টির পক্ষ থেকে তাকে ৩০০ টাকা দেওয়া হয়েছিল। এর বাইরে তেমন কোনো বাজেট ছিল না তাঁর। তাই নির্বাচনে তাঁর পক্ষে প্রচারণায় লোক কম দেখা যায়।

তাঁর অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলিম লীগের প্রার্থী, বরিশালের বামনার জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী (তিনি ছিলেন রাজবাড়ীর পদমদীর জমিদার নবাব মীর মোহাম্মদ আলীর ভ্রাতুষ্পুত্রী আসমাতুন্নেছার স্বামী), টাঙ্গাইলের জমিদার আব্দুল হামিদ গজনভী, ঢাকার নবাববাড়ির আব্দুল করিম ও মফিজ উদ্দিন আহমেদ।

অবশ্য বাংলা একাডেমির জীবনীপঞ্জিতে ওই নির্বাচনে কবি নজরুলের সঙ্গে তমিজউদ্দিন খানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সেবার রাজবাড়ীর (খানখানাপুর) তমিজউদ্দিন খান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মুসলিম লীগ থেকে নিম্ন আইন পরিষদ (গোয়ালন্দ ও ফরিদপুর সদর মহকুমা) আসনে।

স্বরাজ পার্টিকংগ্রেস থেকে নির্বাচন করেন ফরিদপুরের তরুণ জমিদার চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে লাল মিয়া। আর কেন্দ্রীয় আইনসভায় সমগ্র ঢাকা বিভাগ থেকে মুসলমানদের জন্য দুটি আসন সংরক্ষিত ছিল, যার একটিতে কবি নজরুল প্রার্থী ছিলেন।

প্রচারণার জন্য ঢাকার বেচারাম দেউড়ির ৫২ নম্বর বাড়িতে পীর সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ কাদেরীর আস্তানায় বেশ কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন নজরুল। ফরিদপুরেও মাঠপর্যায়ে কাজ করেছিলেন কয়েক দিন। কিন্তু বাজেটুস্বল্পতায় নির্বাচনি এলাকার সবখানে যেতে পারেননি।

ফরিদপুরের এক পীরের কাছ থেকে একটা ফতোয়া লিখেও নিয়ে এসেছিলেন কবি, যাতে লেখা ছিল, সবাই যেন তাকে ভোট দেয়। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভোটের মাঠে ভরাডুবি ঘটে বিদ্রোহী কবির।

কবি অবশেষে জামানতের টাকা রক্ষার তাগিদে ঢাকার দিকে চলে যান। জসিমউদ্‌দীন লিখেছেন

প্রথম ভোটের দিন কবিকে ভোট গ্রাহক অফিসারের সামনে বসাইয়া দিলাম। কবির সামনে গিয়া ভোটাররা ভোট দিবেন। পরদিন সকালে….কবি আমাকে বলিলেন, “দেখ জসীম, ভেবে দেখেছি, এই ভোটযুদ্ধে আমার জয় হবে না। আমি ঢাকা চলে যাই। দেখি, অন্ততপক্ষে জামানতের টাকাটা যাতে মারা না যায়।’

সে সময়ে শুধু সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটার হওয়ার নিয়ম থাকায় বিরাট এলাকা নিয়ে গঠিত আসনে মোট ভোটার ছিল ১৮,১১৬ জন। ফলাফলে দেখা যায়, মাত্র ১ হাজার ৬২টি ভোট পেয়ে পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে চতুর্থ হন তিনি। সে সময় তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।

নির্বাচনী প্রচারণার কাজ শেষে কবি ১৯২৬ সালের ২৩ নভেম্বর কৃষ্ণনগর চলে যান, ২৯ নভেম্বর ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলে দেখা যায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী বরিশালের জমিদার মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী বিজয়ী হন। নিম্ন আইন পরিষদে জয়লাভ করেন তমিজউদ্দিন খান।

সূত্র:

) জীবনী বিদ্রোহী রণক্লান্ত: গোলাম মুরশিদ ২)জীবন কথা: জসীমউদ্‌দীন

পূর্ববর্তী নিবন্ধবীর চট্টলা
পরবর্তী নিবন্ধনির্বাচনের ডামাডোলে নজরুল