নির্বাচনের ট্রেনযাত্রা শুরু, এটা আর থামবে না

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা । জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের প্রতিটি হত্যার বিচার হবে, হাসিনাকে ফেরত চাইব ১৬শ গুমের তথ্য পেয়েছে কমিশন, সাড়ে ৩ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৪ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এজন্য সবার কাছে প্রয়োজনীয় সময় চেয়ে সবাইকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেছেন। সবাইকে বিনা দ্বিধায় মনের কথা তুলে ধরার আহ্বান করেছেন।

গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৭টায় অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। তার এ ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশনবিটিভিসহ রাষ্ট্রীয় সমপ্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়। গণআন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া জুলাইআগস্ট আন্দোলনের প্রতিটি হত্যার বিচার করা হবে জানান। খবর বিডিনিউজের।

জনগণকে দেশের মালিক হিসেবে তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন সংস্কার কমিশনে খোলামেলাভাবে তাদের মতামত তুলে ধরার আহ্বান করেছেন। বলেছেন, আপনি দেশের মালিক। আপনি বলে দিন আপনি কী চান। কীভাবে চান। নির্বাচনের কথা বলার সঙ্গে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের কথাটিও বলুন। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ট্রেনযাত্রা শুরু করার কথা আবারও তুলে ধরেন মুহাম্মদ ইউনূস। বলেন, এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি আর তা হবে রাজনৈতিক দলসমূহের ঐকমত্যের মাধ্যমে। ছাত্রজনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট সরকার পতনের তিন দিন পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারের দায়িত্বে থাকার এই তিন মাসের মধ্যে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সভাসেমিনারে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।

সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া ৩৪ মিনিটের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন আয়োজনের ওপর গুরুত্বরোপ করেন। তিনি কোন প্রেক্ষিতে সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কেন জরুরি সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। একই সঙ্গে এমন একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা বলেন, যা যুগ যুগ ধরে চলতে থাকবে।

তিনি বলেন, আমরা চাইব, আমরা যেন এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারি যা যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করা হবে। এর ফলে সাংবাৎসরিক রাজনৈতিক সংকট থেকে আমাদের দেশ রক্ষা পাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু আমি আপনাদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি।

সংস্কারের জন্য নির্বাচনকে কয়েক মাস বিলম্বিতও করা যেতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিকে নীতির কাঠামোয় আনার জন্য এবং রাজনীতির জন্য নতুন পরিবেশ সৃষ্টির নিবিড় আকাঙ্ক্ষা থেকে। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা থেকে জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত নির্বাচনসহ সংস্কার নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, নির্বাচন কবে হবে এই প্রশ্ন আপনাদের সবার মনেই আছে। আমাদের মনেও সারাক্ষণ আছে। আপনারা লক্ষ্য করেছেন নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। কয়েকদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে। তারপর থেকে নির্বাচন আয়োজন করার সমস্ত দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তাবে।

সরকারের ১০০ দিনের কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দৈনন্দিন রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথাও ভাবতে হচ্ছে। আপনারা সবাই জানেন, আমাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মধ্যদিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতামত নিয়ে যাচ্ছি। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এসব মতামত অনেকাংশে প্রতিফলিত হচ্ছে। চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের প্রতিটি মতামত সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। আমরা আশা করছি নির্ধারিত সময়ে, ডিসেম্বরজানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করতে পারবে। তাদের সুপারিশ নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ক্রমাগতভাবে আলোচনায় বসব। সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই আমরা সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করব।

তবে সংস্কারের এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু সময় পাবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, তবে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার কাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। ততদিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য্য ধারণ করার অনুরোধ করব।

নির্বাচনসহ সংস্কারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা মনে করি না যে, একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিলেই নির্বাচন আয়োজনে আমাদের দায়িত্ব শেষ। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের এ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। আপনারাই আমাদেরকে এ ম্যান্ডেট দিয়েছেন। যে ছয়টি সংস্কার কমিশন আমরা শুরুতে গঠন করেছিলাম তারা ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।

এসব প্ল্যাটফর্মে সবাইকে মতামত দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে আপনাদের সকল বক্তব্য বিনা দ্বিধায় বলতে থাকুন। সবার মনের কথা তুলে ধরুন। আমার অনুরোধ সংস্কারের কথাটাও একই সঙ্গে বলুন। সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে যাবেন না। নির্বাচনের কথা বলার সঙ্গে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের কথাটিও বলুন। সংস্কার হলো জাতির দীর্ঘমেয়াদি জীবনী শক্তি। সংস্কার জাতিকে বিশেষ করে আমাদের তরুণতরুণীদের নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সুযোগ দেবে। জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।

নির্বাচন আয়োজনে সংস্কার কমিশনের সুপারিশে রাজনৈতিক দল ও সবার মতামত নিয়ে নির্বাচনী আইন সংশোধন করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সমান্তরালভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

হাসিনাকে ফেরত চাইব : গণআন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, জুলাইআগস্টের আন্দোলনের প্রতিটি হত্যার বিচার করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রতিটি হত্যার বিচার আমরা করবই। জুলাইআগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারের যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, তার কাজও বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও আমরা ভারত থেকে ফেরত চাইব।

ছাত্রজনতার আন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা। তখন থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। দেশ ছাড়ার পর আওয়ামী লীগ প্রধানের বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ টাইব্যুনালেও তার বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগও জমা পড়েছে। এর মধ্যে ‘গণহত্যার’ দুটি অভিযোগে হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।

জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন, কেবল জুলাইআগস্ট হত্যাকাণ্ডই নয়, আমরা গত ১৫ বছরে সব অপকর্মের বিচার করব। অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছে, খুন হয়েছে এই সময়ে। আমরা গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছি। কমিশন প্রধান আমাকে জানিয়েছেন, অক্টোবর পর্যন্ত তারা ১,৬০০ গুমের তথ্য পেয়েছেন। তাদের ধারণা এই সংখ্যা ৩,৫০০ ছাড়িয়ে যাবে।

পরে আক্রান্ত হতে পারেন, এই ভয়ে অনেকে কমিশনের কাছে গুমের অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আপনারা দ্বিধাহীন চিত্তে কমিশনকে আপনাদের অভিযোগ জানান। কারো সাধ্য নেই আপনাদের গায়ে আবার হাত দেয়, অভয় দিয়ে বলেন তিনি।

গুম কমিশনে যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে, তার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, গুম কমিশনের সদস্যদের কাছে ভুক্তভোগীদের যে বিবরণ আমরা পেয়েছি তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। জুলাইআগস্টের বিপ্লবের পর ছাত্রছাত্রীরা শহর বন্দরের দেয়ালেদেয়ালে তাদের মনের কথা লিখেছে। তাদেরও আগে যারা গুমের শিকার হয়েছে, প্রতিটি গোপন আস্তানার দেয়ালেদেয়ালে তারা লিখে গেছেন তাদের কষ্টের মর্মস্পর্শী বিবরণ। তাদের এসব কষ্টের কথা শুনে আমাদের হৃদয় কেঁপে উঠেছে। এসবের সঙ্গে জড়িতদের আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবই। অভিযুক্ত যতই শক্তিশালী হোক, যে বাহিনীরই হোক তাকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেবল দেশে নয়, গুম, খুন ও জুলাইআগস্ট গণহত্যার সাথে জড়িতদের আমরা আন্তর্জাতিক আদালতেও বিচারের উদ্যোগ নিয়েছি। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান কৌঁসুলি করিম খানের সঙ্গে আমার এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে।

ইউনূস বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কোনো সদস্য কিংবা অন্য কেউ যাতে হত্যা, গুমসহ এ ধরনের কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য আমরা গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছি। আপনারা দেখেছেন, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন। জাতিসংঘ জুলাইআগস্ট হত্যাকাণ্ডের তদন্তে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তারা আমাদেরকে তাদের রিপোর্ট হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অতীতের গুমের ঘটনাগুলোর তদন্ত কাজেও আমরা নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। মানবাধিকার রক্ষায় সহযোগিতা করতে ঢাকায় তারা তাদের জনবল বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছি।

তিনি বলেন, আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিন অতিক্রম করলাম। আপনারা জানেন কী কঠিন এক পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। ছাত্রশ্রমিকজনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান পালিয়ে গেলে দেশ সরকারশূন্য হয় সাময়িকভাবে। পুলিশ প্রশাসনও এ সময় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে উদ্বেগজনক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত এই দেশকে আমাদের সবাইকে মিলে পুনর্গঠন করতে হচ্ছে।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিপ্লব চলাকালে প্রায় দেড় হাজার ছাত্রশ্রমিক জনতার শহীদী মৃত্যু হয়। সরকার প্রতিটি মৃত্যুর তথ্য অত্যন্ত যত্নের সাথে জোগাড় করছে। এই বিপ্লবে আহত হয়েছে ১৯,৯৩১ জন। আহতদের জন্য ঢাকার ১৩টি হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্নীতি ও অর্থপাচারে অভিযুক্ত দেড়শ ব্যক্তির তালিকা তৈরি
পরবর্তী নিবন্ধকর্ণফুলীতে অস্ত্র, গুলি ও মদসহ পিতা-পুত্র গ্রেপ্তার