নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ গেল দুজনের

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নির্বাচনী সহিংসতায় গতকাল নগরে প্রাণ হারিয়েছে দুইজন। এর মধ্যে সকাল ১০টার দিকে ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ইউসেফ আমবাগান টেকনিক্যাল স্কুল ভোট কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও একইদলের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় মো. আলাউদ্দিন (২৮) নামে এক রাজমিস্ত্রী। সে আলাউদ্দিন কুমিল্লার সুলতান হোসেনের ছেলে। এরআগে সকাল পৌনে ৮টার দিকে ১২নং সরাইপাড়া ওয়ার্ডের বারো কোয়ার্টার মাইট্টাইল পাড়া এলাকায় নিজাম উদ্দিন মুন্না (৩৫) নামে এক যুবলীগ কর্মীকে খুন করে তার আপন বড় ভাই। ঘাতকের নাম সালাহউদ্দিন কামরুল। তারা ওই এলাকার গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। পুলিশের দাবি, পারিবারিক বিরোধের জেরে খুন হয় মুন্না। তবে স্থানীয়রা জানিয়েছে, আলাউদ্দিন বিদ্রোহী প্রার্থী মো. সাবের আহমেদের অনুসারি। ঘাতক কামরুল আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. নুরুল আমিনের অনুসারি। এই দুই হত্যকাণ্ডের মাধ্যমে গত ২৭ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনের দিন লাশ দেখল নগরবাসী। এর আগে ২০১৫, ২০১০ এবং ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনের দিন সহিংসতায় নগরে কোন প্রাণহানি হয়নি। তবে ওইসময় নির্বাচনকে ঘিরে আগে ও পরে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
আলাউদ্দিন হত্যাকাণ্ড : পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, সকালে ৮টা থেকে ইউসেফ আমবাগান টেকনিক্যাল স্কুল ভোটকেন্দ্রের বাইরে মুখোমুখি অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী (লাটিম) ও আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহমুদুর রহমানের (রেডিও) অনুসারিরা। তাদের হাতে লোহার রড, ইট, লাটি ও দেশিয় অস্ত্র ছিল বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। এক পর্যায়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে উভয়পক্ষ। এসময় দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে উভয় গ্রুপে। এসময় একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সকাল ১০টার দিকে ওয়াসিমের অনুসারিরা গুলি করলে গুলিবিদ্ধ হয় আলাউদ্দিন। তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন বলে দৈনিক আজাদীকে জানান চমেক পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার।
দুপুর পৌনে ১২ টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে সেখানে। নিহত আলাউদ্দিন হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ করে তারা। এদিকে দুপুর ১২ টার দিকে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এস এম মোস্তাক আহমেদ ইউসেফ আমবাগান টেকনিক্যাল স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শনে যান। এসময় পুলিশের সোয়াত টিমের সদস্যরা লাটিচার্জ করে সরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীদের। এতে এসএম মোস্তাক আহমেদ বলেন, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। খুনের ঘটনাটি আমরা দেখছি। আমাদের নলেজে আছে। কোনো অপরাধীকে ছাড় দেয়া হবে না।
ইউসেফ আমবাগান টেকনিক্যাল স্কুল ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মনিরুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, বাইরের সংঘর্ষের প্রভাব পড়েনি কেন্দ্রের ভেতর। কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা তিন হাজার ৫৫৪টি। ওই সময় পর্যন্ত ১৫ শতাংশ কাস্ট হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, নিহত আলাউদ্দিন আমার সমর্থক। সকালে ভোট শুরুর আগে থেকেই ওয়াসিম উদ্দিনের লোকজন বিভিন্ন কেন্দ্র নিজেদের দখলে নিয়েছে। মধ্যরাত থেকে সন্ত্রাসীরা এখানে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছে।
মায়ের আহাজারি :
ইউসেফ আমবাগান টেকনিক্যাল স্কুল ভোটকেন্দ্রের আনুমানিক ১০০ গজ দূরেই ছিন্নমূল কলোনিতে রয়েছে নিহত আলউদ্দিনের ঘর। সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, ঝুপড়ির মতো ঘরের বাইরে রেললাইনের উপর বসে ছেলের জাতীয়তা সনদ বুকে নিয়ে কাঁদছে আলাউদ্দিনের বয়স্ক মা আছিয়া খাতুন। কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তিনি। জ্ঞান ফিরতেই ‘আমার ছেলে কই, ফিরিয়ে আন’ চিৎকার করছিলেন তিনি। এসময় স্বজনরা তাকে শান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
নিহতের ভাগনী পরিচয় দিয়ে মাসুদা আকতার দৈনিক আজাদীকে বলেন, মামা কাজে চলে যেতেন। তাই নাস্তা করতে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু নাস্তা করে ফিরতে পারেনি। তার আগেই মামাকে ওরা মেরে ফেলেছে। মামা হত্যার বিচার চাই।’ আলাউদ্দিনের বোন জাহানারা বেগম বলেন, নাস্তা করে তার কাজে যাওয়ার কথা ছিল। মোড়ে পৌঁছতেই লাটিম মার্কার (আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী) লোকজন এসে তাকে গুলি করে। নিহত আলাউদ্দিনের ভাই জসিম জানান, হামলাকারী পুরুষদের সাথে মহিলারাও ছিল।
ভাইয়ের হাতে ভাই খুন :
স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, পৌনে ৮টার দিকে ১২নং সরাইপাড়া ওয়ার্ডের বারো কোয়ার্টার মাইট্টাইল পাড়া এলাকায় নিজাম উদ্দিন খুনের বিষয়ে তার ভাতিজা আফতাব উদ্দিন ইমন আজাদীকে জানায়, ভোর ৭টার দিকে ঘুম থেকে ওঠে আফতাব ও মুন্না পাশের বাড়িতে কাউন্সিলর প্রার্থী সাবেরের পক্ষে ভোট কেন্দ্রে যেতে নির্বাচনী এজেন্ট ডাকতে যায়। ফিরে আসার সময় ‘মা’ ভবনের সামনে আগে থেকে ১৫/২০ জন সাঙ্গপাঙ্গসহ ওঁৎ পেতে ছিল কামরুল। এসময় মুঠোফোনে কথা বলার সময় মুন্নাকে পেছন থেকে প্রথমে ছুরিকাঘাত করে কামরুলের এক সঙ্গী। এসময় লুটিয় পড়ে মুন্না তার ভাই কামরুলের পায়ে ধরে না মারার অনুরোধ করে। তখন কামরুল মুখ চেপে ধরে মুন্নাকে জবাই করে দেয় বলে জানায় তার ভাতিজা ইমন।
পাহাড়তলী থানার ওসি হাসান ইমাম জানান, আপন বড় ভাইয়ের হাতে ছোট ভাই খুন হয়েছে। বড় ভাই সালাউদ্দিন কামরুল এখনো পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারে আমরা অভিযান চালাচ্ছি। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মুন্না ছিলেন তৃতীয়। মুন্নার স্ত্রী নাসরিন আকতার সুমী বাকপ্রতিবন্ধী। তাদের সংসারে আছে আড়াই বছরের কন্যা বিবি মরিয়ম এবং ৮ মাসের পুত্র ইব্রাহিম।
স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, পারিবারিক বিরোধ থাকলেও নির্বাচনকে ঘিরে দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব তীব্র হয়। মুন্না সরাইপাড়া ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মো. সাবের আহমেদের হয়ে এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছিল। সালাউদ্দিন কামরুল আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী নুরুল আমিনের কর্মী বলে পরিচিত। ফেইসবুকেও দুই ভাই দুই প্রার্থীর হয়ে বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাউন্সিলর পদে কে কত ভোট পেলেন
পরবর্তী নিবন্ধকাউন্সিলর প্রার্থী ঘিরেই সংঘাত