নির্বাচনী পোস্টারে জলাবদ্ধতার ঝুঁকি বাড়ছে নগরে, সাথে আছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। কারণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রচারণার জন্য লাগানো পোস্টারগুলোতে রয়েছে ‘থার্মাল লেমিনেশন ফিল্ম’ বা পলিথিনের আবরণ। ফলে পোস্টারগুলো হয়ে গেছে অপচনশীল। সঠিক উপায়ে অপসারণ করে ধ্বংস না করলে নালা–নর্দমায় গিয়ে আটকে যাবে এসব পোস্টার। এতে দুর্বল হবে ড্রেনেজ সিস্টেম, বাড়বে জলাবদ্ধতা। একইসঙ্গে অপচনশীল পলিথিন ভেঙে রূপ নেয় ‘মাইক্রোপ্লাস্টিকে’ (প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রতম কণা)। যা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে বাড়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ অবস্থায় পরিবেশ সম্মত উপায়ে নির্বাচনী পোস্টার ও ব্যানার অপসারণে জোর দিচ্ছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়টির পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন, ২০২৪ শেষে নির্বাচনী প্রচারণা সামগ্রী দ্রুত অপসারণ ও পরিবেশসম্মত উপায়ে ‘ডিসপোজাল’ (নিষ্পত্তি) করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দেশের সব সিটি কর্পোরশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে অনুরোধ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর প্রধান নির্বাহী, জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সকল পৌর মেয়র এবং ইউপি চেয়ারম্যানদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়।
কী পরিমাণ পোস্টার নগরে : নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত রোববার অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে চারটি (চট্টগ্রাম–৮, ৯, ১০ ও ১১) নগরের। এসব আসনে মোট প্রার্থী ছিল ৩৩ জন। এছাড়া চট্টগ্রাম–৪ এবং চট্টগ্রাম–৫ আসনের আংশিকও নগরের সঙ্গে যুক্ত। ওই দুই আসনে রয়েছেন আরো ১৫ প্রার্থী। সব মিলিয়ে ৪৮ প্রার্থীর পোস্টার–ব্যানার লাগানো হয় নগরে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্ন বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, শহরের অলিগলিতে লাগানো নির্বাচনী পোস্টারের সংখ্যা কয়েক লাখ হতে পারে। তাদের ধারণা–নগর এবং উপজেলার ছয়টির আসনের হেভিওয়েট প্রার্থীরা বেশি পোস্টার লাগিয়েছেন। এমন প্রার্থীর সংখ্যা ১২ জন। তাদের পক্ষে গড়ে দুই লাখ পোস্টার লাগালেও কমপক্ষে ২৪ লাখ পোস্টার লাগানো হয় নগরে।
এদিকে গতকাল দিনভর নগরের বিভিন্ন জায়গায় সরেজমিন পরিদর্শনে চসিকের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের নির্বাচনী পোস্টার অপসারণ করতে দেখা যায়নি। তবে সন্ধ্যার পর থেকে পোস্টার অপসারণ কার্যক্রম শুরু হয় বলে দাবি করেন পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্র্র্তারা।
চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমী গতরাতে আজাদীকে বলেন, আমরা দ্রুত অপসারণ করে ফেলব। সন্ধ্যা থেকে কয়েক জায়গায় অপসারণ করা হচ্ছে। রাতে আবর্জনা অপসারণে যুক্ত পরিচ্ছন্নকর্মীরা ময়লা অপসাণের পাশাপাশি নির্বাচনী পোস্টারও অপসারণ করে ফেলবে। যেগুলো অবশিষ্ট থাকবে তা আগামীকাল মঙ্গলবার (আজ) ড্রেন থেকে ময়লা অপসারণে যুক্ত শ্রমিকরা অপসারণ করবে।
জলাবদ্ধতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি : পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচন উপলক্ষে প্রচারণার কাজে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টারসহ নানাবিধ নির্বাচনী প্রচারণা সামগ্রী ব্যবহৃত হয়। নির্বাচনী প্রচারপত্র, ব্যানার বা কাগজে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন বা লিফলেটকে সুরক্ষা প্রদান ও আকর্ষণীয় করার জন্য ‘থার্মাল লেমিনেশন ফিল্মের’ ন্যায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। যা ‘বায়োডিগ্রেডেবল’ (ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য মাধ্যমে পচনশীল) বা ‘কম্পোস্টেবল’ (সার এ রূপান্তর) নয়। তাই এসব কাগজ পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করতে গেলে প্লাস্টিক লেমিনেশন অপসরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে এগুলো কাগজের সাথে থেকে যায়।
পত্রে বলা হয়, এ সকল অপচনশীল সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। দেশের প্রাকৃতিক জলাশয়, নদ–নদী এবং সমুদ্রে জমা হয়ে জলজ প্রতিবেশ ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। অপচনশীল প্লাস্টিক ধীরে ধীরে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। যা পরবর্তীতে ‘ফুড–চেইনে’ যুক্ত হয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে ক্ষতি সাধন করে। এছাড়া, এ সকল প্রচারপত্র, ব্যানার বা কাগজ পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ বাড়বে এবং পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতিসাধন করবে।
এগিয়ে এল বিদ্যানন্দ : নির্বাচনী পোস্টার রিসাইকেল প্রজেক্টের আওতায় গতকাল নগরের কয়েক জায়গা থেকে নির্বাচনী পোস্টার অপসারণ করে সংগ্রহ করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কর্মীরা। সংগৃহীত পোস্টার দিয়ে তারা খাতা বানাবে।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের বোর্ড মেম্বার মো. জামাল উদ্দীন আজাদীকে বলেন, সিআরবি, লালখান বাজার থেকে দুই নম্বর গেইট, হাই লেবেল রোড, চকবাজার অলি খাঁ থেকে প্যারেড কর্নারসহ কয়েক জায়গা থেকে ১০ হাজার নির্বাচনী পোস্টার এবং শ’খানেক ব্যানার অপসারণ করেছি। পোস্টার দিয়ে খাতা বানানো হবে। তবে সব পোস্টার দিয়ে খাতা বানানো যাবে না। সেগুলো দিয়ে খাবার প্যাকেটসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ বানানো হবে। ব্যানার দিয়ে স্কুল ব্যাগ, বাজারের ব্যাগ এবং কলম–পেন্সিল রাখার ব্যাগ বানানো হবে। তিনি বলেন, ভোটের দিন বিভিন্ন নির্বাচনী ক্যাম্প থেকে অব্যবহৃত লিফলেটও সংগ্রহ করেন আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা। যেসব নির্বাচনী উপকরণ রি–সাইকেল করা যাবে না সেগুলো কেটে রান্নার চুলায় ব্যবহার করা হবে। তিনি বলেন, আগামীকাল (আজ) আমরা অপসারণ করব। একই সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের উচিত পোস্টারগুলো অপসারণ করা।