দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটছে মৃত্যু, পঙ্গুত্ব বরণ করছে অসংখ্য মানুষ, বিনষ্ট হচ্ছে সম্পদ। অবিরাম লিখে চলেছি, মৃত্যুর ঘটনা। রাস্তায় বের হলে সুস্থভাবে বাড়ি ফেরার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর যেন কোন প্রতিকার নেই। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তির পরিবারে নেমে আসছে অবর্ণনীয় বিপর্যয়। মানুষের কান্নার রোল দিনদিন ভারী হচ্ছে। গত ৫ জানুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরেছে ৮ হাজারের বেশি প্রাণ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গেল বছরে বিভিন্ন যানবাহনের দুর্ঘটনায় রাস্তায় প্রাণ গেছে ৮ হাজার ৫৪৩ জনের। এছাড়া বিদায়ী বছরে রেল ও নৌপথ মিলিয়ে দুর্ঘটনায় মোট ৬৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত বছরে দুর্ঘটনার এই পরিসংখ্যান উঠে এসেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে। গত শনিবার রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, গেল বছরে ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত ও ১২ হাজার ৬০৮ জন আহত হয়েছে। এই সময়ে ২ হাজার ৩২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৫৭০ জন নিহত ও ৩ হাজার ১৫১ জন আহত হয়েছে, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৬.৬২ শতাংশ, নিহতের ৩০.০৮ শতাংশ ও আহতের ২৪.৯৯ শতাংশ। এছাড়া গেল বছর রেলপথে ৪৯৭টি দুর্ঘটনায় ৫১২ জন নিহত, ৩১৫ জন আহত হয়েছে। আর নৌপথে ১১৮টি দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত, ২৬৭ জন আহত এবং ১৫৫ জন নিখোঁজ রয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে মোট ৬ হাজার ৯৭৪টি দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ২৩৭ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ১৯০ জন আহত হওয়ার তথ্য এসেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে।
দুর্ঘটনার অর্ধেকই মোটর সাইকেল, নসিমন–করিমন ও ইজিবাইকের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে জানিয়ে মোজাম্মেল বলেন, গত বছরের সংঘটিত দুর্ঘটনায় মোট ৯ হাজার ৭১৭টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে। এর মধ্যে ১৩.৪৫ শতাংশ বাস, ২৩.৩৩ শতাংশ ট্রাক– পিকাপ–কাভার্ডভ্যান ও লরি, ৬.২১ শতাংশ কার–জিপ–মাইক্রোবাস, ৫.৫৭ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ২৭.৪৮ শতাংশ মোটর সাইকেল, ১৬.৫৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৭.৩৭ শতাংশ নসিমন–করিমন–মাহিন্দ্রা–ট্রাক্টর ও লেগুনা সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দুর্ঘটনা ভয়াবহ বাড়লেও এসব সংবাদ গণমাধ্যমে কম আসায় প্রকৃত চিত্র তুলে আনা যাচ্ছে না বলেও সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়।
সড়কে এভাবে মর্মান্তিক মৃত্যুই যেন নিয়তি এখন। ফলে সড়কপথে ভ্রমণ করা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো–চালকের অদক্ষতা, চালকের ক্লান্তি, গাড়ির বেপরোয়া গতি এবং গাড়ির ফিটনেস না থাকা।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তম্মধ্যে মানুষের জীবন রক্ষায় সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা; দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করা; সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে সড়ক নিরাপত্তা উইং চালু করা; সড়ক নিরাপত্তায় ইতিমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়নে নানা কার্যক্রম শুরু করা; দেশের সড়ক–মহাসড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা; জেব্রা ক্রসিং অংকন ও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা; গণপরিবহন চালকদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা উল্লেখযোগ্য।
সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার পাশাপাশি নতুন করে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, সড়ককে নিরাপদ করার জন্য জাতিসংঘের কৌশলপত্রে পাঁচটি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো, সড়ক নিরাপদ করতে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা, সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, রোডক্র্যাশ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ও যান চলাচলের নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা। অভিযোগে প্রকাশ, সড়ক দুর্ঘটনা তদারকির দায়িত্বে বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ ও জেলা প্রশাসন থাকলেও কোনো দপ্তরেরই এ সমস্যা রোধে তাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। সমন্বয় জরুরি। তাছাড়া, ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহন ও মোটরসাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন।