নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার

| বুধবার , ২৮ মে, ২০২৫ at ১০:২০ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক

ডা. সামশুন নাহার

নিরাপদ মাতৃত্ব বলতে এমন একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বোঝায়, যার মাধ্যমে গর্ভধারণ, প্রসব ও প্রসবপরবর্তী সময়কাল নারীর জন্য নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং জটিলতামুক্ত হয়। এটি মা ও নবজাতকের জীবনের ঝুঁকি কমিয়ে একটি সুস্থ পরিবার গঠনে সহায়তা করে। নিরাপদ মাতৃত্বের মূল উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে গর্ভকালীন সেবা (এন্টিনেন্টাল কেয়ার); গর্ভাবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টি, টিকা, রক্তচাপ ও রক্তের পরীক্ষা ইত্যাদি নিশ্চিত করা। সক্ষম ও প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা মিডওয়াইফ দ্বারা প্রসব; প্রসব যেন দক্ষ হাতের মাধ্যমে, প্রেফারেবলি হাসপাতালে বা ক্লিনিকে হয়। প্রসবপরবর্তী সেবা; সন্তান জন্মের পর মা ও শিশুর যত্ন, স্তন্যদান, রক্তক্ষরণ বা সংক্রমণ পর্যবেক্ষণ। জরুরি প্রসূতি সেবা; প্রসবজনিত জটিলতার সময় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা। পরিবার পরিকল্পনা; অনিরাপদ ও ঘন ঘন গর্ভধারণ প্রতিরোধে সচেতনতা ও ব্যবস্থা। নিরাপদ মাতৃত্বের লক্ষ্য হলো মাতৃমৃত্যু হ্রাস করা। নবজাতক মৃত্যুর হার কমানো। নারীর স্বাস্থ্যের উন্নয়ন। সচেতন পরিবার ও সমাজ গঠন। নিরাপদ মাতৃত্ব কেবল স্বাস্থ্যসেবার বিষয় নয়; এটি নারীর অধিকার, সমাজের দায়িত্ব এবং উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। প্রতিটি গর্ভবতী নারীর নিরাপদ মাতৃত্ব পাওয়ার অধিকার আছে। মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণগুলো মূলত চিকিৎসা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে সংঘটিত হয়।

এর মধ্যে রয়েছে, প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ প্রসবের সময় বা পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ সবচেয়ে বড় ও তাৎক্ষণিক প্রাণঘাতী কারণ। প্রাথমিক চিকিৎসার অভাব থাকলে এটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে। গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ, হাতপা ফুলে যাওয়া এবং খিচুনি দেখা দিতে পারে, যা মস্তিষ্কে আঘাত বা মৃত্যু ঘটাতে পারে। অপ্রশিক্ষিত বা অদক্ষ ব্যক্তি দ্বারা প্রসব করানো হলে জটিলতা দেখা দিতে পারেযেমন সন্তান আটকে যাওয়া, জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়া ইত্যাদি। প্রসবের সময় বা পরে জীবাণু সংক্রমণ ঘটলে দ্রুত চিকিৎসা না পেলে তা মারাত্মক হতে পারে। অনিরাপদ গর্ভপাত বা অসময়ে বন্ধ্যাত্ব ঘটানোর চেষ্টা মাতৃমৃত্যুর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য একটি সমস্যা, তবে তা সরকার, এনজিও এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ হার কমানো সম্ভব। এরজন্য মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাথমিক স্তরে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মিডওয়াইফ ও নার্সদের প্রশিক্ষণ করাতে হবে। সকল অঞ্চলে জরুরি প্রসূতি সেবা নিশ্চিতকরণ এবং কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. জসীম উদ্দিন

অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

অল্প বয়স থেকে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানবিশেষ করে যেমন মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল গুলোনিম্নোক্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি; স্কুল পর্যায়ে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও জীববিজ্ঞান পাঠ্যক্রমে মাতৃত্বকালীন পুষ্টি, গর্ভধারণের প্রক্রিয়া, নিরাপদ প্রসব, ও প্রসবপরবর্তী যত্নের মৌলিক ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। মেডিকেল কলেজে ক্লিনিক্যাল ট্রেনিং ও কমিউনিটি মেডিসিনের অংশ হিসেবে নিরাপদ মাতৃত্ব সংক্রান্ত বাস্তব প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান, নারীবিষয়ক অধ্যয়ন ও পাবলিক হেলথ বিভাগে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য বিষয়ে কোর্স বা সেমিনার রাখলে শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে। সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। সেমিনার ও ওয়ার্কশপ; বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা সচেতনতামূলক সেশন আয়োজন, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা সরাসরি প্রশ্ন করতে পারে। হেলথ ক্যাম্প; শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে গর্ভবতী নারীদের জন্য স্থানীয় কমিউনিটিতে সেবা ও সচেতনতা প্রদান করলে এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়বে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ক্লাব বা সংগঠন গঠন করা যেতে পারে। হেলথ ক্লাব বা ইয়ুথ ফোরাম গঠন; যেখানে নিয়মিত মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, এবং প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনার আয়োজন করা হবে। সচেতনতা বাড়ানোরন জন্য মিডিয়া ও সৃজনশীল মাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে। নাটক, পোস্টার, ভিডিও, ও সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন করে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এসব মাধ্যমে স্বাস্থ্য বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। পিতামাতা ও অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা স্কুলে অভিভাবক সভায় মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতনতামূলক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা। গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীদের নিয়ে প্র্যাকটিক্যাল প্রজেক্ট (বিশেষত মেডিকেল কলেজে) গ্রামীণ এলাকায় ফিল্ড ওয়ার্কের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ ও সচেতনতা বৃদ্ধি। এই ধরনের উদ্যোগ কিশোরকিশোরীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করে, ভবিষ্যতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয় এবং একটি স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম গঠনে ভূমিকা রাখে। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে পুরুষ ও পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু নারীর দায়িত্ব নয়, বরং একটি সমন্বিত পারিবারিক ও সামাজিক প্রচেষ্টা হওয়া উচিত। এর জন্য কিছু কার্যকর উপায় রয়েছে। তাহলো শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি; পুরুষদের জন্য বিশেষ সেশন করা। স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল বা কমিউনিটিতে পুরুষদের লক্ষ্য করে গর্ভাবস্থা, প্রসব ও প্রসবপরবর্তী সময়ের যত্ন নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করা। বিবাহপূর্ব বা বিবাহপরবর্তী কাউন্সেলিংয়ে পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব বিষয়ে সমান দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করা। পরিবারভিত্তিক কাউন্সেলিং; স্বামীস্ত্রীর যৌথ পরামর্শ সেবার জন্য মাতৃত্বকালীন সময়ের চাহিদা, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে একসাথে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করার ব্যবস্থা করা। শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সচেতনতা বৃদ্ধি: বিশেষ করে শাশুড়ি, শ্বশুর ও অন্যান্য সদস্যদের গর্ভবতী নারীর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানানো। নির্ধারিত ভূমিকা ও দায়িত্ব বণ্টন; গর্ভাবস্থায় স্বামী যেন স্ত্রীর মানসিক ও শারীরিক সহায়তা দেয়, যেমন: হাসপাতালে যাওয়াআসার ব্যবস্থা করা, নিয়মিত চেকআপে নিয়ে যাওয়া, ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়া, জরুরি অবস্থায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা। মিডিয়া ও ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার; গণমাধ্যমে নাটক, বিজ্ঞাপন ও রেডিও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরুষদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরা। ইমাম বা পাদ্রী বা পুরোহিতদের মাধ্যমে সমাজে বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যে মাতৃত্বে পুরুষের সহায়তা ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। পুরুষদের জন্য ইনসেনটিভ ও স্বীকৃতি; পরিবারে সচেতন ভূমিকা রাখা বাবাদের জন্য সম্মাননা বা সামাজিক স্বীকৃতি প্রদান করা যেতে পারে, যা অন্যদের উদ্বুদ্ধ করবে।

পারিহা আকতার

নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

আজ আমরা নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস উপলক্ষে একত্রিত হয়েছি। এই দিনটি একটা মায়ের নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য তার ব্যক্তিগত পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও মানবিক দায়িত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয়। আমরা যদি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক নারীদের কথাই বলি, তাহলে দেখতে পাইঅনেকে এখনো মাতৃস্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতন না। তারা জানেন না, কোথায় গেলে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যাবে। কোথায় কমমূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যাবে অথবা ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে। প্রেগনেন্সির কখন কোন সময়টাতে চেকআপে যেতে হবে কিংবা কোন লক্ষ্মণগুলো দেখা দিলে আসলে হাসপাতালে যাওয়া উচিত। অনেক সময় এ কারণগুলোর জন্য সমাজের কুসংস্কার শিক্ষা এবং তথ্যের অভাব অথবা সীমাবদ্ধতা ও পারিবারিক চাপের কারণে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে পারেন না। এই সমস্যা সমাধানে আমাদের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের যে মাধ্যমগুলো আছে সেখানে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেই পারে। আমি বলবো এটি এখন অনেক বড় মাধ্যম হয়ে গেছে। কারণ সবার হাতে এখন স্মার্টফোন চলে এসেছে। সবাই হয়তো টিভি দেখি, অনেকগুলো প্রোগ্রামের মাধ্যমেও কিন্তু সচেতন করা যায়। আমরা মিডিয়াকে আরো বেশি সক্রিয় দায়িত্ববান এবং মানবিক হতে বলবো। টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতৃস্বাস্থ্য সচেতনতামূলক বার্তা নিয়মিত প্রচার করতে হবে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে প্রজনন স্বাস্থ্য ও নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা খুবই প্রয়োজন। যাতে তারা ছোটবেলা থেকে বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত থাকে। গ্রামে মসজিদ, মন্দির কিংবা চার্চে, ইমাম, পুরোহিত কিংবা পাদ্রীদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে বার্তাগুলো আসলে পৌঁছে দেয়া দরকার। তারা যদি সপ্তাহে একটি দিনও অন্তত এই বিষয়ে কথা বলেন, আমার মনে হয় সেটি একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে। এছাড়া স্থানীয় নাটক বা পথনাটিকা ব্যবহার করে সহজ ভাষার মধ্যে এই বার্তাগুলো পৌঁছে দেয়া সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন সুস্থ মা মানে একটি সুস্থ পরিবার ও সুস্থ জাতি। তাই আমাদের সম্মানিত উদ্যোগে সচেতনতা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। শহর থেকে গ্রামে, স্কুল থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে।

অধ্যাপক ডা. শামীমা সিদ্দিকা

ইমার্জেন্সি অবৃসটেট্রিক কেয়ার বা ইওসি এমন একটি চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা যেখানে প্রসবকালীন বা প্রসবপরবর্তী জটিলতা মোকাবেলায় তাৎক্ষণিক ও দক্ষ চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এটি মাতৃমৃত্যু ও নবজাতক মৃত্যুরেধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইওসি’র প্রধান সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছেমাতৃমৃত্যু হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা এবং গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, প্রসবজনিত সংক্রেমণ হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো সম্ভব হয়। এছাড়া নবজাতকের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়। জন্মের সময় শ্বাসকষ্ট, অকাল জন্ম বা কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর জন্য বিশেষ যত্ন ও চিকিৎসা পাওয়া যায়। এছাড়া দক্ষ জনবল ও বিশেষায়িত সেবা ইওসি কেন্দ্রে সাধারণত প্রশিক্ষিত ডাক্তার, মিডওয়াইফ, নার্স এবং অস্ত্রোপচারের সুবিধা থাকে। এসব সেন্টআরে অস্ত্রোপচারের সুযোগ রয়েছে। জরুরি ক্ষেত্রে সিজারিয়ান ডেলিভারির ব্যবস্থা থাকায় প্রসবকালীন জটিলতা মোকাবেলা। রক্তক্ষরণজনিত জটিলতা দেখা দিলে রক্ত সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা থাকে। জরুরি ওষুধের মধ্যে রয়েছেঅক্সিটোসিন, অ্যান্টিবায়োটিক। অনেক ইওসি কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে, যাতে যেকোনো সময় গর্ভবতী নারী সাহায্য নিতে পারে। আমাদেরর দেশে দুই ধরনের ইওসি কেন্দ্র রয়েছে। একটি হচ্ছে বেসিক ইওসি। এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণ প্রসূতি সেবা, ওষুধ ও স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া আরকটি হচ্ছে কম্প্রিহেন্সিভ ইওসি কেন্দ্র। এখানে উন্নতমানের সেবা যেমন অস্ত্রোপচার, রক্তসঞ্চালন, ও আইসিইউ স পোর্ট ইত্যাদি প্রদান করে। ইওসি একটি অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, যা গর্ভবতী নারীর জরুরি অবস্থা সামাল দিতে সক্ষম। বিশেষ করে জন্য এই সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হলে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। সাধারণত প্রতি ৫ লাখ জনবসতির জন্য ৪টি বেসিক ইওসি এবং একটি কমপ্রিহেন্সিভ ইওসি সেন্টার থাকা প্রয়োজন।

ডা. প্রীতি বড়ুয়া

প্রাক্তন সিনিয়র কনসালটেন্ট, মেমন মাতৃসদন

বাংলাদেশে বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী বাস করে গ্রামে। তাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শহরে এসে ডাক্তার বা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নার্স দিয়ে হাসপাতালে ডেলিভারি করানোর সক্ষমতা নেই। তাই প্রসবকালীন সময়ে অদক্ষ দাত্রী দিয়ে ঘরে ডেলিভারি করাতে গেয়ে প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং মা ও নবজাতকের মৃত্যু হয়। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুরোধ করতে সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও আলাদা আলাদা মিডওয়াইফারি ইন্সটিটিউট তৈরি করে এবং ৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেন। এরই মধ্যে প্রায় ৭ হাজার ২৩০ জন ডিপ্লোমা মিডওয়াইফ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিপ্লোমা মিডওয়াইফেরা প্রসবপূর্বক, প্রসব কালীন এবং প্রসবোত্তর সেবা দান করেন। আমাদের দেশে গ্রামে শতকরা ৭৫ ভাগ ডেলিভারি মিডওয়াইফ করে। এছাড়া জরুরি প্রসূতি সেবা সহ মায়েদের পুষ্টি, বুকের দুধ খাওয়ানো ও পরিবার পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়ে থাকে। মাতৃমৃত্যু রোধ করতে মানসম্মত ও নিরাপদ প্রসব করাতে দক্ষ ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মিডওয়াইফের বিকল্প নেই। মিডওয়াইফের আরো সুযোগ সুবিধা বাড়ানো এবং আরো উচ্চতর ট্রেনিং এর প্রয়োজন আছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন

পরিচালক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাতৃসেবায় বেশকিছু উন্নত সেবা প্রদান করা হলেও কিছু কৌশলগত সীমাবদ্ধতা এখনো বিদ্যমান, যা নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : জনবল ও দক্ষতার ঘাটতি: শুধুমাত্র মিডওয়াইফ নয়, অভিজ্ঞ গাইনী ও অবস্‌ ডাক্তার, প্রশিক্ষিত নার্স ও থিয়েটার স্টা সব ক্ষেত্রেই জনবল ঘাটতি দেখা যায়, বিশেষত জরুরি সময়গুলোতে। পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। গর্ভবতী নারীদের জন্য পৃথক পর্যবেক্ষণ ইউনিট ও হাইরিস্ক ওয়ার্ড এখনো সীমিত; ফলে একাধিক রোগীকে একই বেড শেয়ার করতে হয়। জরুরি সেবায় চাপ বাড়ছে। প্রসবকালীন জরুরি অবস্থায় ইক্লেমপসিয়া, পিপিএইচ বা অবস্ট্রাক্টিভ লেবার মোকাবিলায় পর্যাপ্ত সংখ্যক অপারেশন থিয়েটার ও আইসিইউ সুবিধা কম রয়েছে। রেফারেল ব্যবস্থায় দুর্বলতার রয়েছে। নিম্নস্তরের হাসপাতালগুলো থেকে সময়মতো রোগী রেফারেল না হওয়া এবং রেফারেলকৃত রোগীর অবস্থা ও প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তথা না থাকা, চিকিৎসায় বিলম্ব ঘটায়। টিম ওয়ার্ক ও ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা। নার্স, মিডওয়াইফ ও চিকিৎসকদের মধ্যে আরও সুসংবদ্ধ সমন্বয় ও দায়িত্ব বণ্টনের প্রয়োজন রয়েছে।

এর সমাধানে হতে পারে যদি প্রতিটি স্তরে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিয়মিত দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেয়া যায়। ইরেফারেল সিস্টেম চালু করে সময়মতো রোগী স্থানান্তর, ক্রাইসিস রেসপন্স টিম গঠন ও জরুরি পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখা, দায়িত্বভিত্তিক টিম ওয়ার্ক গড়ে তোলা মেডিকেল অফিসার, মিডওয়াইফ ও নার্সদের সমন্বয় করা সম্ভব হলে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয়ক মূল লক্ষ্য হলোমাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০এর নিচে নামিয়ে আনা। যদিও এসডিজির টার্গেট হচ্ছে ৩ দশমিক ১। এছাড়া সর্বজনীন ও সমতাভিত্তিক মাতৃসেবা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নতমানের জরুরি প্রসবসেবা ও পোস্টস্টনাটাল কেয়ার সহজলভ্য করতে হবে। এছাড়া এই লক্ষ্য অর্জনে কিছু বান্ধব ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যেমনপ্রতিটি উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ জরুরি প্রসবসেবা (ইডিসি) চালু ও কার্যকর রাখা, মিডওয়াইফ, নার্স, চিকিৎসক সবার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা, প্রতিটি গর্ভবর্তী মাকে এএনসি থেকে পিএনসি পর্যন্ত একটি ই ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনা, হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেমে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকায় সিএসবিএ, মোবাইল ক্লিনিক ও টেলিমেডিসিন সার্ভিস সমপ্রসারণ করা, পরিবারে ও পুরুষদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, স্বাস্থ্যসেবায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, গবেষণা, ডেটা বিশ্লেষণ ও মৃত্যু পর্যালোচনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

অধ্যাপক ডা. রওশন মোরশেদ

এন্টিনেন্টাল কেয়ার বা গর্ভকালীন পরিচর্যা গর্ভবর্তী নারীর ও গর্ভস্থ শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা। গর্ভকালীন পরিচর্যার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ। নিয়মিত রক্তচাপ, ওজন, রক্ত, প্রস্রাব পরীক্ষা করে মায়ের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ। রক্তশূন্যতা, ডায়াবেটিস, প্রিএক্লাম্পসিয়া ইত্যাদি চিহ্নিত করে দ্রুত চিকিৎসা। এরপর রয়েছে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের মনিটরিং করা। এজন্য আলট্রাসাউন্ড, ফিটাল হার্টবিট পর্যবেক্ষণ করে শিশুর অবস্থান ও স্বাস্থ্য জেনে নেওয়া। জেনেটিক বা জন্মগত সমস্যা আগেভাগে শনাক্ত করা। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরামর্শ প্রদান করা। পুষ্টিকর খাদ্য, বিশ্রাম, ও পরিশ্রম নিয়ে উপযুক্ত নির্দেশনা দেওয়া। ধূমপান, মাদক বা ক্ষতিকর ওষুধ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় টিকা ও সাপ্লিমেন্ট প্রদান। টিটিবি টিকা, আয়রনফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি দিতে হবে। সংক্রমণ ও পুষ্টির ঘাটতি প্রতিরোধ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা শনাক্ত করতে হবে। অস্বাভাবিক লক্ষণ যেমন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, মাথা ঘোরা, পা ফোলা ইত্যাদি দেখে আগেভাগে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী রেফারাল নিশ্চিত করা। প্রসব প্রস্তুতি ও পরামর্শ প্রদান করতে হবে। প্রসব কোথায় ও কীভাবে হবে সে সম্পর্কে পরিকল্পনা করতে হবে। প্রসবকালীন বিপদজনক লক্ষণ চেনাতে সাহায্য করতে হবে। নিয়মিত এন্টিনেন্টাল কেয়ার গ্রহণকারী মায়েদের জটিলতা কম হয় এবং প্রসবের সময় নিরাপদ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেছে, কমপক্ষে ৮ বার অঘঈ ভিজিট করা উচিত, যাতে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। কিশোরী স্বাস্থ্য ও বাল্যবিবাহ এই দুটি বিষয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং সমাজে কিশোরীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার অন্যতম বড় কারণ হলো বাল্যবিবাহ। শারীরিক স্বাস্থ্য; ১০১৯ বছর বয়সে শরীর দ্রুত পরিবর্তন ও বিকাশ লাভ করে। প্রয়োজন হয় পুষ্টিকর খাবার, মাসিককালীন পরিচর্যা ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা। মানসিক স্বাস্থ্য; হরমোন পরিবর্তনের কারণে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যায়। সঠিক পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ। প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা; কিশোরীদের মাসিক চক্র, প্রজনন অঙ্গের গঠন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি। যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা ও সঠিক শিক্ষা তাদের আত্মবিশ্বাস ও সচেতনতা বাড়ায়।

অধ্যপক ডা. শর্মীলা বড়ুয়া

জেনারেল সেক্রেটারি, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম শাখা

ওজিএসবি একটি অরাজনৈতিক পেশাজীবী সংগঠন। যা গাইনী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত। এটি ১৯৭২ সালে যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে গঠিত হয়। এর সদস্য সংখ্যা সারা বাংলাদেশে প্রায় ৩ হাজার জন। এই সংগঠনের ১৯ টি শাখা রয়েছে,এরমধ্যে চট্টগ্রাম শাখা সর্ববৃহৎ, যার সদস্য সংখ্যা ২৮১। এই সংগঠন নারী স্বাস্থ্য, প্রসবপূর্ব, প্রসবপরবর্তী, জরুরী প্রসূতি সেবা এবং নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই সংগঠন নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য সরকার এবং এনজিওদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দান করে। এছাড়া প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারে এই সংগঠনের সুপারিশ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ওজিএসবি ‘এওফওজি’ ‘এসএএফওজি’ এবং ‘এফআইজিও’র অধিভুক্ত সদস্য। এই সংগঠন গর্ভবতী নারীর মাতৃত্ব নিরাপদ করতে বদ্ধ পরিকর। আমাদের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেগর্ভকালীন সময়ে সৃষ্ট জটিলতায় উদ্ভাবিত উন্নত চিকিৎসা সম্বন্ধে সদস্যদের অবহিত করার জন্য নিয়মিত সেমিনারের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকরা স্বস্ব কর্মস্থল নিয়োজিত জুনিয়র ডাক্তার, সেবিকা ও মিডওয়াইভদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন এবং দিয়ে থাকেন। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভকালীন সময়ে পরিচর্যা, প্রসবকালীন এবং প্রসবপরবর্তী সৃষ্ট জটিলতা সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের অবহিত করার জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির পদক্ষেপ নেয়া হয়। আমরা জানি, মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। প্রসবপরবর্তী এই জটিলতা প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য ‘পিপিএইচ ম্যানেজম্যান্ট বাই বান্ডেল এপ্রোচ’বর্তমানে প্রচলিত। এই পদ্ধতিতে রোগীর চিকিৎসা প্রদানের জন্য আমরা প্রশিক্ষিত হয়ে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ জন চিকিৎসক, সেবিকা এবং মিডওয়াইফকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এই সমস্ত রুগীকে রেফার করা এবং রক্তক্ষরণ জনিত কারণে মাতৃমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমেছে। ভবিষ্যতে যে সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে প্রসবের ব্যবস্থা আছে, সেই প্রতিষ্ঠানে এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা আছে। প্রয়োজনে রিফ্রেশার প্রশিক্ষণেরও উদ্যোগ নেয়া হবে। মাতৃত্বকে নিরাপদ রাখতে ওজিএসবি সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং এই কাজে আমরা সবাই বদ্ধপরিকর।

ডা. ফাহমিদা ইসলাম চৌধুরী

হেড অব গাইনী ডিপার্টমেন্ট, চমেক হাসপাতাল

মাতৃত্বকালীন মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের দেশে এখনো একটি তুলনামূলকভাবে অবহেলিত ক্ষেত্র, যদিও এটি মা ও শিশুর উভয়ের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই বিষয়টিকে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বর্তমানে গর্ভবতী মায়েদের পরামর্শকালীন সময়ে মনঃসামাজিক মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। প্রসবপূর্ব ও প্রসবপরবর্তী জটিলতার সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক চিহ্নিত করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের রেফারেল দেওয়া হচ্ছে। কিছু নার্স ও মিডওয়াইফকে প্রাথমিক পর্যায়ের সাইকোসোশাল কাউন্সেলিং স্কিল শেখানো হচ্ছে। তবে আরও সুসংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক মনোযোগ প্রয়োজনবিশেষ করে উপজেলা ও কমিউনিটি পর্যায়ে। প্রসবপরবর্তী বিষণ্নতা বা পোস্টপার্টাম একটি নীরব মহামারির মতো। এদের সহায়তায় এখনো সার্বজনীন ব্যবস্থা না থাকলেও কিছু কার্যকর উদ্যোগ বিদ্যমান। বড় হাসপাতালগুলোতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া যায়, তবে এটি নিয়মিত সেবার অংশ নয়। কিছু এনজিও ও প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও হেল্পলাইন চালু হয়েছে। গাইনী বিভাগে আমরা চেষ্টা করি মা যদি অতিরিক্ত উদ্বেগ, কান্নাকাটি, ঘুম না হওয়া বা শিশুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলার মতো উপসর্গ দেখান, তাহলে দ্রুত কাউন্সেলিং ও রেফারেল নিশ্চিত করতে।

ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী

সিভিল সার্জন, চট্টগ্রাম

বাংলাদেশে নিরাপদ মাতৃ স্বাস্থ্য অর্জনের পথে অবকাঠামোগত দিক থেকে বেশ কয়েকটি বড় বাধা রয়েছে, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত ঘাটতি হলোপ্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অপ্রতুলতা ও দুর্বলতা। অনেক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, দক্ষ জনবল ও প্রসবপরবর্তী সেবা দিতে অক্ষম। অনেক স্থানে ২৪/৭ জরুরি প্রসব সেবা নেই, ফলে প্রসবকালীন জটিলতা হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। দক্ষ জনবলের ঘাটতি; প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ ও গাইনোকলজিস্টের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, বিশেষ করে গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকায়। স্বাস্থ্য সহকারীদের প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং দুর্বল, ফলে তারা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার সঠিক চিহ্নিতকরণে বার্থ হন। রেফারাল ও অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা দুর্বল; অনেক উপজেলায় সঠিক রেফারাল সিস্টেম নেই, ফলে জটিল রোগীকে দ্রুত উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে পাঠানো সম্ভব হয় না। অ্যাম্বুলেন্স স্বল্পতা ও খরচ বেশি, যা দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। জরুরি প্রসবসেবা কেন্দ্রের সীমাবদ্ধতা; সরকার নির্ধারিত ইমার্জেন্সি অবসটেট্রিক এন্ড নিউবর্ন কেয়ার সেন্টার অনেক উপজেলায় নেই, অথবা কার্যকরভাবে পরিচালিত হয় না। স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির দুর্বলতা; ডিজিটাল হেলথ রেকর্ড বা ট্র্যাকিং সিস্টেম নেই বললেই চলে, ফলে গর্ভবতী নারীদের অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা কঠিন। বাংলাদেশে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বড় অবকাঠামোগত ঘাটতি হলোদক্ষ জনবল ও জরুরি প্রসব সেবার জন্য সুসজ্জিত, কার্যকর ও সহজপ্রাপ্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অভাব। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য দরকার স্বাস্থ্য অবকাঠামোর বিস্তার, মানবসম্পদের উন্নয়ন ও ডিজিটাল প্রযুক্তির একীভূত প্রয়োগ। দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকায় মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা বিস্তারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হলে পরিকল্পিত, বহুমাত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগ প্রয়োজন। এর জন্য কিছু বাস্তবমুখী প্রস্তাবনা হলোমোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট চালু করা। সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে গর্ভবতী নারীদের জন্য মোবাইল মেডিকেল ভ্যানের মাধ্যমে চেকআপ, ওষুধ, পুষ্টি পরামর্শ এবং রেফারাল সেবা প্রদান। এতে সরাসরি ঘরে ঘরে পৌঁছে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী ও মিডওয়াইফ নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ; স্থানীয় নারীদের স্বল্পমেয়াদি ট্রেনিং দিয়ে প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ বা স্বাস্থ্য সহকারী তৈরি করা। তারা স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি বুঝে গর্ভবতী নারীদের আস্থা অর্জনে বেশি সফল হন। টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার; ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করে ভিডিও কনসালটেশনের মাধ্যমে শহরের চিকিৎসকদের সেবা পৌঁছে দেওয়া। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইপ্রেসক্রিপশন ও রেফারাল ব্যবস্থাও রাখা যায়। অ্যাম্বুলেন্স ও রেফারাল ব্যবস্থার উন্নয়ন; কম খরচে বা বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদান নিশ্চিত করা। জরুরি অবস্থায় দ্রুত রেফারাল সেন্টারে পাঠানোর জন্য ডিজিটাল রেফারাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা। স্বাস্থ্য অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ; প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২৪ ঘণ্টা প্রসব সেবার সুবিধাসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। বিদ্যুৎ, পানি ও স্বাস্থা সরঞ্জামের নিশ্চয়তা দেওয়া। কমিউনিটি সচেতনতা ও অংশগ্রহণ; স্থানীয় ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক সভা ও ক্যাম্পেইন চালানো। পরিবার ও সমাজে গর্ভবতী নারীর গুরুত্ব ও যত্ন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। এক্ষেত্রে পাবলিকপ্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল অনুসরন করে বেসরকারি হাসপাতাল, এনজিও ও সরকার যৌথভাবে দূরবর্তী অঞ্চলে সেবা প্রদান করতে পারে। দূরবর্তী এলাকাগুলোর জন্য একটি সাশ্রয়ী, প্রযুক্তিনির্ভর ও স্থানীয়ভাবে অভিযোজিত সেব্যমডেল গড়ে তুলতে হবে, যা সরাসরি গর্ভবতী নারীদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

অধ্যাপক ডা. শাহানারা চৌধুরী

প্রসবপরবর্তী সেবা হলো সেই স্বাস্থ্যসেবা যা মা ও নবজাতক শিশুকে প্রসবের পর প্রথম ছয় সপ্তাহ বা ৪২ দিন পর্যন্ত দেওয়া হয়। এই সময়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, কারণ প্রসবপরবর্তী জটিলতা বা সংক্রমণ এই সময়েই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। প্রসবপরবর্তী সেবার গুরুত্ব অনেক বেশি। মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধ; প্রসবের পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ বা উচ্চ রক্তচাপের কারণে অনেক নারীর মৃত্যু হয়। পিএনসি থাকলে এসব ঝুঁকি আগে থেকে চিহ্নিত ও চিকিৎসা করা সম্ভব। নবজাতকের যত্ন; শিশুর জন্মের পর শ্বাসকষ্ট, সংক্রমণ, কম ওজন, দুধ না পাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়যা সময়মতো সনাক্ত ও সমাধান করা যায় এবং করা অত্যন্ত জরুরি। স্তন্যপান ও পুষ্টি বিষয়ে পরামর্শ; মাকে কিভাবে বুকের দুধ দিতে হবে, শিশুর জন্য উপযুক্ত খাবার কী হবেএসব বিষয়ে পিএনসি সেবায় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। মানসিক স্বাস্থ্য; প্রসবপরবর্তী হতাশায় ভোগেন অনেক নারী, যা মনোযোগ পেলে সহজেই কাটানো যায়। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনার সঠিক পদ্ধতি বেছে নিতে সাহায্য করা হয়। সংক্রমণ ও সেলাইয়ের যত্ন; সিজারিয়ান বা প্রাকৃতিক প্রসবের পর সেলাই বা পরিধেয় অংশের যত্ন নেওয়ার নিয়ম শেখানো হয়, যাতে সংক্রমণ না হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রসব পরবর্তী আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেবা রয়েছে। অনেক মা প্রসবের পর স্বাস্থ্যসেবায় ফিরে যান না। গ্রামীণ নারীরা প্রায়ই প্রসবের পর বিশ্রাম ও যত্ন পান না।

সেলিনা আক্তার

নির্বাহী পরিচালক, ইমেজ (সমাজ কল্যাণ সংগঠন)

সরকারি ও বেসরকারি মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজলভ্য ও কার্যকর করতে হলে কিছু কাঠামোগত, প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছেসেবাপ্রদানে সমন্বয় ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তথা ও রেফারাল সিস্টেমে একীভূততা আনা। পাবলিকপ্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল ব্যবহার করে বেসরকারি হাসপাতালকে সরকারি সেবার সহায়ক হিসেবে যুক্ত করা। সেবার মূল্য হ্রাস ও ভর্তুকি প্রণয়ন। দরিদ্র ও প্রান্তিক নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবায় ভর্তুকি বা স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা। বেসরকারি হাসপাতালে নির্দিষ্ট সেবা যেমন: প্রসব, অ্যান্টিনেটাল চেকআপ নির্ধারিত হারে সবার জন্য উন্মুক্ত করা। সেবা গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজীকরণ; কমপ্লেঙ ও হাসপাতালগুলোতে ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস পয়েন্ট’ চালু করা, যেখানে রেজিস্ট্রেশন, চেকআপ, ওষুধ ও রেফারাল এক জায়গায় পাওয়া যাবে। ডিজিটাল হেল্পলাইন, মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সেবার সময়সূচি, অবস্থান, ফি ইত্যাদি জানা সহজ করা। জনবল ও অবকাঠামোর উন্নয়ন; সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত ডাক্তার, মিডওয়াইফ, নার্স নিয়োগ ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। দুর্গম এলাকায় নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন এবং বেসরকারি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রণোদনা দেওয়া। স্বাস্থ্যবীমা ও সামাজিক নিরাপত্তা; স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যবীমা চালু করা। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যেমন: মাতৃত্বকালীন ভাতা আওতা বৃদ্ধি ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিতরণ নিশ্চিত করা। স্থানীয় সরকার ও এনজিওর অংশগ্রহণ; ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমিটি গঠন করে তদারকি ও জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা। এনজিওদের সঙ্গে যৌথভাবে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, ফ্রি হেলথ ক্যাম্প পরিচালনা। জবাবদিহিতা ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার; সরকারি ও বেসরকারি উভয় সেবাদানকারীদের জন্য মানসম্মত সেবা যাচাইয়ের নিয়মিত মনিটরিং ও মূল্যায়ন চালু করা। অভিযোগ গ্রহণ ও তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য কমপ্লেইন বঙ, হেল্পলাইন ও অনলাইন ফিডব্যাক ব্যবস্থা চালু করা। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে হলে চাই সমন্বিত পরিকল্পনা, প্রযুক্তির ব্যবহার, ভর্তুকিমূলক নীতি এবং জনগণের অংশগ্রহণ। শুধু অবকাঠামো নয়, সেবার মান, প্রাপ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতাএই তিন দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

অধ্যাপক ডা. কামরুন নেসা রুনা

প্রেসিডেন্ট

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম শাখা।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও হেড অব গাইনী বিভাগ, মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম।

২৮শে মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ীপ্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ৮০০ জন নারী মাতৃত্বজনিত কারণে মারা যান; এর একটি বড় অংশই প্রতিরোধ যোগ্য। আমাদের দেশে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকার ২৮শে মে কে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। সেই থেকে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এবছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে-‘কোন মাকে পিছনে না রেখে: মাতৃ স্বাস্থ্য সেবায় সমতা’। অবস্ট্রেটিক্যাল এন্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নারীস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও মাতৃত্বকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি লাখে জীবিত শিশু জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ৯০। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য মাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৭০ এ কমিয়ে আনতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই দৈনিক আজাদী ও ইমপেরিয়াল হাসপাতালের সহযোগিতায় ওজিএসবি চট্টগ্রামের আজকের এই গোল টেবিল আলোচনা। এই দিবসে আমরা একত্রিত হয়েছি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে প্রত্যেক মা যেন সুস্থ থাকে, নিরাপদে সন্তান প্রসব করতে পারে এবং মাতৃত্বকে আনন্দময় ভাবে গ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশে মাতৃত্ব এখনো অনেক নারীর জন্য ভয় এবং অনিশ্চয়তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমরা জানি একটি মায়ের মৃত্যু শুধু একটি জীবন নয় পরিবারের ভবিষ্যতকে ও ছিন্ন করে দেয়। আমরা অবস ও গাইনি সোসাইটি অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম অঙ্গীকার করছি। আমাদের বেশ কিছু উদ্যোগ আছে এরমধ্যে রয়েছেপ্রতিটি মাকে গর্ভকালীন সেবা ও সঠিক পরামর্শ পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করব। নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষিত ধাত্রী কর্মীদের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাব। গরিব প্রান্তিক নারীদের মাতৃত্ব সেবা নিশ্চিত করার জন্য নীতি নির্ধারকদের সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলবো। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন এবং নারীর প্রতি সহমর্মিতা গড়ে তুলতে আমরা জাতীয়ভাবে কাজ করব। আমরা বিশ্বাস করি একজন সুস্থ মা মানেই একটি সুস্থ জাতি। নিরাপদ মাতৃত্ব কোন বিলাসিতা নয়, এটি প্রতিটি নারীর অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার, পেশাজীবী সমাজ, বেসরকারী সংস্থা ও জনগণের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। আসুন আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি বাংলাদেশের কোন মাকে ও নিরাপদ মাতৃতে ঝুঁকি নিতে দেব না।

ওজিএসবি চট্টগ্রামের সুপারিশমালা রয়েছেমাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মাধ্যমে সরাসরি বা ইট্র্যাকিংএর মাধ্যমে সকল গর্ভবতী মাকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা। প্রসবপ্রস্তুতি পরিকল্পনা গর্ভবতী নারী ও তার পরিবারের সাথে আলোচনা করা। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে ডেলিভারি অবশ্য সুবিধা সম্বলিত জরুরি সেবা কেন্দ্রে করানো। দুর্গম অঞ্চলের প্রসূতির জন্য সিএসবিএকে প্রাথমিক বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সচল করে মিডওয়াইফলিড কেয়ার সার্ভিস দেওয়া। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যু পর্যালোচনা করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রতিটি মাতৃমঙ্গল কেন্দ্রে ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জরুরী প্রসূতি সেবা নিশ্চিত করা। শক্তিশালী ও বাস্তবমুখী রেফারেল পদ্ধতি কার্যকর করা। সচেতনতা বৃদ্বির জন্য গণমাধ্যম ও বিলবোর্ড,পোষ্টার ইত্যাদির ব্যবহার নিশ্চত করা। বাল্যবিবাহ ও কিশোরী গর্ভধারন প্রতিরোধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ণ। নিরাপদ মাতৃত্বের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্বতি সমূহের যথাযথ ব্যবহার এবং মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যু রোধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

অধ্যাপক ডা. অজয় দেব

ডীন, ফ্যাকাল্টি অব বেসিক সায়েন্স ও ক্লিনিক্যাল সায়েন্স, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য অধিকার ও সেধ্য সম্পর্কে সচেতনতার মাত্রা সাধারণত কম। তবে এটি এলাকা, শিক্ষা, আর্থসামাজিক অবস্থা এবং এনজিও বা সরকারিভাবে পরিচালিত উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। সচেতনতার নিম্নমাত্রার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছেশিক্ষার অভাব। অনেক প্রান্তিক নারী প্রাথমিক শিক্ষাও সম্পূর্ণ করতে পারেন না, ফলে প্রজনন ও মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য জানার সুযো সীমিত। অবিশ্বাস ও কুসংস্কার। চিকিৎসা পদ্ধতি, গর্ভাবস্থার যত্ন, বা হাসপাতাল প্রসবের বিষয়ে কুসংস্কার প্রচলিত, যেমন প্রসব ঘরে না হলে অশুভ। অধিক নির্ভরতা দাই বা আত্মীয়ের ওপর: পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীর বদলে স্থানীয় অনভিজ্ঞ দাইয়ের ওপর নির্ভরতা দেখা যা। এছাড়া সেবা সম্পর্কে সীমিত ধারণাও একটি কারণ। যেমন: সরকারি সেবার তথ্য না জানা। অনেক নারী জানেন না যে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনামূল্যে গর্ভকালীন চেকআপ করা হয়। ওষুধ বা টিটির মতো সেবা পাওয়া যায়। নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কম হওয়ায় (যেমন: চিকিৎসা নিতে যেতে চাইলে স্বামীর অনুমতি প্রয়োজন) মাতৃত্বকালীন সেবা গ্রহণ। তবে বর্তমানে ব্র্যাক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের কারণে অনেক এলাকায় সেবার চাহিদা ও সচেতনতা বাড়ছে। সাধারণত প্রান্তিক নারীদের মধ্যে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য অধিকার ও সেবা বিষয়ে সচেতনতা এখনও অপ্রস্থল, তবে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে তা উন্নত করা সম্ভব।

ডা. কামরুন নাহার দস্তগীর

মা ও শিশু মেডিকেল কলেজ বা নার্সিং কলেজসমূহে নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। এরমধ্যে রয়েছেপ্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা শিক্ষা। এর মাধ্যমে গর্ভধারণ, গর্ভনিরোধক পদ্ধতি, নিরাপদ গর্ভপাত, ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া কিশোরী স্বাস্থ্য, পিউবার্টি ও মেনস্ট্রয়াল হাইজিন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীর সেবা মধ্যে রয়েছেএ্যান্টিনেটাল (গর্ভকালীন) ও পোস্টনেটাল (প্রসব পরবর্তী) সেবা। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার চিহ্নিতকরণ ও রেফারাল ব্যবস্থাও রয়েছে। নিরাপদ প্রসবসেবা ও নবজাতক যত্ন এবং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শিক্ষা ও কাউন্সেলিং চালু রয়েছে। জেন্ডারবেইজড ভায়োলেন্স বিষয়ে শিক্ষা ও সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও রেফারাল সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ক প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছেনারীর প্রজনন অধিকার, স্বাস্থ্যসেবায় নারীর অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছেকমিউনিটি লেভেলে হেলথ ক্যাম্প, সচেতনতামূলক সেমিনার, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ। নারী ও কিশোরীদের নিয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়ার্কশপে নার্সিং শিক্ষার্থীদের নারী স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে মাতৃমৃত্যু রোধে নার্সদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক। তাদের দায়িত্ব শুধু চিকিৎসা সেবায় সীমাবদ্ধ না থেকে সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপেও বিস্তৃত হওয়া উচিত। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে. গর্ভকালীন (এ্যান্টিনেটাল ) সেবা. গর্ভবর্তী নারীর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা, ডায়াবেটিস, প্রিএকুযামসিয়া ইত্যাদি চিহ্নিত করা, পুষ্টি, আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও দ্রুত রেফার করা। প্রসবকালীন (ইন্ট্রানেন্টাল) সেবায় নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন প্রসব সেবা নিশ্চিত করা। জরুরি অবস্থায় (যেমন অতিরিক্ত বক্তক্ষরণ, শক) তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও চিকিৎসা। যথাযথ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা। প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ হিসেবে দায়িত্ব পালন। এছাড়া প্রসবপরবর্তী (পোস্টনেন্টাল) সেবা প্রসবপরবর্তী জটিলতা (রক্তক্ষরণ, ইনফেকশন) চিহ্নিত করে ব্যবস্থাপনা মাতৃদুগ্ধ পান করানো বিষয়ে সহযোগিতা ও পরামর্শ। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন প্রসবপরবর্তী বিষন্নতা। নজর রাখা। এছাড়া স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কমিউনিটিতে মা ও পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা। পরিবার পরিকল্পনা, নিরাপদ মাতৃত্ব ও প্রসববিষয়ক শিক্ষা প্রদান। স্থানীয় মাতৃসদনে প্রসবের গুরুত্ব বোঝানো। রেফারাল ও জরুরি ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিপূর্ণ বা জটিল রোগীকে সঠিক সময়ে উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে রেফার করা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজামায়াত নেতা আজহারুল ইসলাম কারামুক্ত
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে বিষাক্ত সাপের কামড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু