নিরাপদ খাবার ও ব্যবহারযোগ্য পানি মৌলিক অধিকার হিসেবে অনবদ্য রায়

| সোমবার , ৩ মার্চ, ২০২৫ at ১২:১২ অপরাহ্ণ

নিরাপদ খাবার ও ব্যবহারযোগ্য পানিকে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। রায়টিকে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবী।

রায়ে আদালত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে বলেছেন, সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানযোগ্য পানি পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার। এ পানির অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নিরাপদ পানযোগ্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য আদালত বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। আগামী এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক স্থান অর্থাৎ আদালত, ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল, রেলস্টেশন, হাটবাজার, এয়ারপোর্টসহ প্রত্যেক পাবলিক প্লেসে নিরাপদ পানযোগ্য পানি প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিরাপদ ও পানযোগ্য পানি সাশ্রয়ী মূল্যে নিশ্চিতের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২০২৬ সালের মধ্যে সব পাবলিক প্লেসে নিরাপদ বিনামূল্যে সরবরাহ পানির কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেই মর্মে একটি রিপোর্ট সরকারকে আদালতে দাখিল করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ রায় একটি চলমান আদেশ হিসেবে থাকবে। হাইকোর্ট ঘোষিত তুরাগ নদের রায়, সোনারগাঁর রায় ও হাতিরঝিলের রায়ের নির্দেশনাগুলোও এ রায়ের নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত হবে। বাংলাদেশের যত পানির উৎস রয়েছে, এ পানির উৎস যাতে ক্ষয়িষ্ণু না হয় অর্থাৎ পানি শুকিয়ে না যায়, পানি অনিরাপদ না হয়, পানি দূষিত না হয় সেগুলোকে সংরক্ষিত করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিরাপদ খাবার ও ব্যবহারযোগ্য পানি নিশ্চিত করতে ২০২০ সালে সুয়োমোটো রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। সেখানে বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য নিরাপদ পানযোগ্য পানি সরবরাহ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব কিনা অথবা এ নিরাপদ পানি পাওয়ার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা যায় কিনা এ মর্মে রুল জারি করা হয়েছিল। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে আদালত রায় ঘোষণা করেছেন।

খাদ্যে ভেজাল নতুন কোনো বিষয় নয়। এ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপক আলোচনা চলছে। প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য প্রতিবেদন। ভেজাল বিরোধী অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে কিছুদিন পর পর। খাবারের মান নির্ণয় করতে রেস্তোরাঁগুলোর জন্য গ্রেডিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সব কিছুর পরও দূষিত ও ভেজাল দেওয়ার বিষয়টি যেন নির্ভেজালই থেকে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাটাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন রাজধানীর ৬৩ লাখ মানুষকে মধ্যাহ্নভোজসহ দিনরাতে হোটেলরেস্তোরাঁর খাবারের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু মানুষ জেনে বা না জেনে অথবা কোন উপায় না পেয়ে একরকম বাধ্য হয়ে নিম্ন মানের খাবার পরিভোগ করছে। শুধু হোটেলরেস্তোরাঁয় নিম্নমানের খাবার নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় সিংহভাগ পণ্যই ভেজাল বা বিষক্রিয়ার বাইরে নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে ভেজাল, নিম্নমানের খাবার, অনিরাপদ পানিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে ভেজালের কারণে মানবস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। সমপ্রতি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রাজধানীর ২০০ খাবারের মান পরীক্ষার একটি সমীক্ষা চালিয়েছে।

প্রাথমিক রাজধানীর ২০০ হোটেলরেস্তোরাঁ বেছে নেয়া হয়। পরীক্ষার জন্য দুঃখজনকভাবে মাত্র ৫০টির খাবার স্বাস্থ্যসম্মত বলে বিবেচিত হয়েছে। এর বাইরে আর রেস্তোরাঁগুলোর খাবার ফুডগ্রেডের অনেক নিচে। ইতোপূর্বে হাইকোর্ট এক আদেশে বলেছেন, খাদ্যে ভেজাল মেশানো, একটি বড় দুর্নীতি। আমরা অনেক বছর ধরে ভেজাল বিরোধী কিছু অভিযান পরিচালিত হতে দেখেছি। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ভেজালের বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। কিন্তু ভেজাল রোধ করতে এসব অভিযান বা পদক্ষেপ প্রত্যাশিত সুফল দিতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে কেবল খাদ্যে নয়, ভেজাল রয়েছে সব জায়গাতেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভেজাল রোধ করা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ, কিন্তু সংখ্যায় ভরপুর। এ কারণে এদেশে সমস্যার অন্ত নেই। ভেজাল, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি দূর করাও যেন মস্তবড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় গুণগত পরিবর্তন আবশ্যক। আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চাষাবাদের জন্য কৃষককে আগ্রহী করতে হবে। এছাড়া এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ ও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সচেতনতার মাধ্যমে নিরাপদের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে। এক গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, আমাদের শরীরে ৩৩ শতাংশ রোগ হওয়ার পিছনে রয়েছে, ভেজাল খাদ্য। পাঁচ বছরের নিচে শিশুর ৪০ ভাগ রোগ হয় দূষিত খাদ্য থেকে। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবারের টেবিলে আসা পর্যন্ত নানা পর্যায়ে দূষিত হয়। এর মূল কারণ অসচেতনতা। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে না পারলে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করার কথা ভাবাও যায় না, চিন্তা করাতো দূরের কথা।

নিরাপদ পানিকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনজুর বলেন, ‘রায়টি চলমান (কন্টিনিউয়াস মেন্ডামাস) রাখা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, এই রায় না মানলে যে কেউ প্রতিকার চেয়ে আদালতে আসতে পারবেন।’ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। রায়টি বাস্তবায়িত হলে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে ও পানিবাহিত রোগ থেকে মানুষ রক্ষা পাবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে