নিরাপত্তা সুরক্ষায় পুলিশের অবদান অবধারিত

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ২২ মার্চ, ২০২৫ at ৯:১৮ পূর্বাহ্ণ

যেকোন জাতিরাষ্ট্রে উন্নয়ন গতিধারার প্রবাহমানতায় দেশের সার্বিক নিরাপত্তা অপরিহার্য। পবিত্র সংবিধান সম্মত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জনকল্যাণের প্রধান উৎস। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সাবলীল ধারাবাহিকতায় আইনশৃঙ্খলার গুরুত্ব অপরিসীম। সাধারণত ইতিবাচক ব্যবস্থার উদ্ভাবন ও যথার্থ কার্যকরী প্রয়োগ বিরূপ অবস্থানকে বিপর্যস্ত করে। সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে পারস্পরিক মেলবন্ধনে গ্রন্থিত করার উদ্যোগে আইনশৃঙ্খলার অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজ উন্নয়নসমগ্র নাগরিকবৃন্দের জীবনমান সমৃদ্ধকরণে আইনশৃঙ্খলার যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংরক্ষণ সমাজের উৎকর্ষ দ্যোতনা হিসেবে বিশ্বস্বীকৃত। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, পুলিশবাহিনী দেশে নিরাপত্তা সুরক্ষায় সম্মুখ সারির যোদ্ধা। নগরশহরগ্রামীণ জনপদসহ দেশব্যাপী যেকোন ধরনের অপরাধদুর্ঘটনা ও নানামুখী আইনগত সমস্যার বিষয়ে পুলিশবাহিনীকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে নাগরিকবৃন্দের আইনের প্রতিকার প্রাপ্তিতে থানা বা পুলিশের দ্বারস্ত হওয়া প্রচলিত পরিক্রমা। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) লিপিবদ্ধসহ মামলামোকদ্দমা আনুষঙ্গিক সূচনাপাঠ হয়ে থাকে পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে। যেকোন পর্যায়ে থানা হচ্ছে আইনের শাসনের প্রথম আশ্রয় কেন্দ্র। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও জটিল বিষয়ে সমাধানকল্পে আইনের ধারা প্রয়োগ থানার ওপর নির্ভরশীল। ফৌজদারি অথবা দেওয়ানি মামলার উভয়ক্ষেত্রে আইনের ধারাসমূহের প্রায়োগিক ব্যবহার পুলিশের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে।

এটি সর্বজনবিদিত যে, বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মৌলিক ভিত্তি নির্মিত হয়েছে পুলিশ বাহিনীর সংগঠনে। পুলিশ বাহিনীর প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস পর্যালোচনায় সরকারের অনুগত বাহিনী হিসেবে ১৭৮৯ সালে সংঘটিত ফরাসী বিল্পবের পর ফ্রান্সের রাজা হেনরি সমাজের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কয়েকটি বাহিনী গঠন করেন। এমন একটি সংস্থার প্রধান ছিল গ্যাবরিয়েল মন্টগোমারি যাঁর অন্যতম কাজ ছিল দুষ্কৃতকারী সম্পর্কে নানা কৌশলে সংবাদ সংগ্রহরাজা হেনরিকে তা জানানো এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। সে সময় রাজা হেনরির বিরোধী পক্ষ ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ ছিল যে, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্মূলের জন্য সরকার এই বাহিনী সৃষ্টি করেছে।

ভারতবর্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মৌর্যগুপ্তপালচন্দ্রবর্মণসেন আমলে পুলিশি ব্যবস্থা বিরাজমান ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের শাসনকালে রাষ্ট্রীয় গোপন পুলিশের অস্তিত্ব ও মুসলিম শাসনে প্রশাসনিক ব্যবস্থার অগ্রগতির সাথে উন্নত পুলিশি ব্যবস্থাও ক্রমান্বয়ে উন্নততর অবস্থানে এগিয়ে যায়। সর্বপ্রথম দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত প্রতিষ্ঠা করে প্রশাসনিক কাঠামোয় পরিবর্তন নিশ্চিত করা হয় সম্রাট শেরশাহ’র আমলে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে হোসেন শাহী’র বংশের শাসনকালে সুসংগঠিত পুলিশ ব্যবস্থার প্রচলন প্রাচীন তথ্যউপাত্তে প্রমাণিত। মোগল সম্রাটগণ শেরশাহ’র আমলের পুলিশি ব্যবস্থাকে রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যায়ে সম্প্রসারিত করে। ভারতবর্ষে মোগল শাসন বা সুলতানী আমলে শহর অঞ্চলে কোতোয়াল পদমর্যাদায় পুলিশ দায়িত্বরত ছিল। সম্রাট আকবরের আমলে তিনভাগে বিভক্ত প্রশাসনিক কাঠামো বা মীর আদাল (সম্রাটের প্রধান প্রতিনিধি), কাজী (প্রধান বিচারক) এবং কোতোয়াল (বড় বড় শহরের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা) খ্যাত বিষয়টি ভারতবর্ষে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করে। এই ব্যবস্থা অনুসারে ঢাকা চট্টগ্রামসহ জেলা শহরের সদর পুলিশ স্টেশন কোতোয়ালী থানা বলে প্রসিদ্ধী লাভ করে।

১৮৫৬ সালে বৃটিশ বেনিয়ার শাসনকালে ভারতবর্ষে স্বতন্ত্র একটি পুলিশ বাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৮৬১ সালে দ্যা কমিশন অব দ্যা পুলিশ এ্যাক্ট বৃটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় এবং এরই অধীনে প্রতিটি প্রদেশে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (প্রদেশ পুলিশ প্রধান) এবং সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ (জেলা পুলিশ প্রধান) পদ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলে ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশ পুলিশ হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান কার্যকর রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার পরিচালনার প্রাথমিক পর্যায় থেকে অশুভ শক্তির নানামুখী চক্রান্তষড়যন্ত্র ও দেশকে বিপন্নবিপর্যস্ত করার নানা অপকৌশল নস্যাৎ করে দেশ গড়ার কাজে এই বাহিনীর কর্মযজ্ঞ বিপুলভাবে উচ্চকিত ও নন্দিত।

ইতোমধ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশ যে দৃশ্যমান সফলতা অর্জিত হয়েছে, তা শুধু দেশে নয় বিশ্ব পরিমন্ডলে বিপুলভাবে প্রশংসিত এবং সমাদৃত। সন্ত্রাস দমনে এই সংস্থার পারদর্শিতা, বিচক্ষণতা, সাহসীকতা সমুজ্জ্বল এবং সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছে। আমাদের তরুণ সমাজ ও কিশোরকিশোরীরা আইনত দন্ডনীয় যে সব অপরাধ কর্মের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে; দেশের সকল সচেতন মহল, পরিবার, অভিভাবক এবং পুরো জনগোষ্ঠী যে কারণে মারাত্নক আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে, এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ও জনগণের আস্থার সংকট মোচন করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অধিকতর পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশেষ করে জাতিসংঘের অধীনে শান্তি মিশনে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে সংস্থাটি নিজেদের এবং একই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন, জুলাই ২০২৪ ছাত্রজনতার অসাধারণ গৌরবদীপ্ত গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অধিকাংশক্ষেত্রে স্বস্তিজনক পরিবেশ ফিরে আসলেও স্বার্থান্বেষী মহলসন্ত্রাসীদুষ্কৃতকারীরা ডাকাতিরাহাজানিলুটপাটে লিপ্ত রয়েছে। এতে জনগণের জানমালের ক্ষতি হচ্ছে না, প্রচন্ড আতঙ্কউৎকন্ঠা জনমনে গভীর বাসা বাঁধছে। বিভিন্ন উত্থাপিত অভিযোগে সংখ্যালঘু নির্যাতন, মাজারমসজিদমন্দির ভাঙা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানদোকানপাট ভাঙচুরলুটপাট এবং সরকারিবেসরকারি জমিবাড়িঘর দখলের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা উচ্চারিত হচ্ছে। এতে দেশবাসী যারপরনাই কাতরতায় নিপতিত। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সারাদেশে এখনো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পরিপূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসাবাণিজ্যে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। সরকারের পটপরিবর্তনে বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি নিয়েও দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। একপক্ষকে সরিয়ে আরেকপক্ষ দখলে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। বিশ্লেষকদের মতে, চলমান অবস্থায় রাষ্ট্র সংস্কারে সারাদেশে প্রয়োজনীয় সকল খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হতে হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা এবং নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভীতি রয়েছে তা দূর করা। দেশব্যাপী এখন যে হামলালুটতরাজ হচ্ছে দ্রুততর সময়ের মধ্যে সেগুলো বন্ধ করা।

অতিসম্প্রতি পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক পুলিশ বাহিনীসহ দেশবাসীর হৃদয়ে নতুন আশা সঞ্চারিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দেশ বদলাতে হলে একক নির্দেশে নয়, বরং সবাইকে নিয়ে একটি টিম হয়ে কাজ করতে হবে। দেশে যত টিম আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পুলিশ। সরকার যা কিছুই করতে চায়, শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাত দিয়েই করতে হয়। তারা সব করে দেয় না, তারা পরিবেশটা সৃষ্টি করে। যে পরিবেশটা না থাকলে কোনো কাজই আর হয় না। পুলিশের কথা প্রসঙ্গে বারবার আমরা দুটি শব্দ বলছি আইন ও শৃঙ্খলা। পুলিশের হাতেই এটাকে কার্যকর করতে হবে। এই পরিবেশ সৃষ্টি করা না গেলে সরকার, গণতান্ত্রিক ও নাগরিকের অধিকারের কিছুই থাকে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পুলিশকে অবহেলা করে দেশ গড়তে পারব না। তারাই সম্মুখসারির মানুষ। তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেই বাকি জিনিসগুলো হয়। আইনশৃঙ্খলা না থাকলে যত বড় বড় চিন্তাই হোক, যত টাকাই থাকুক, কোনো কাজে আসবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজ করতে পুলিশের অত্যন্ত বেগ পেতে হচ্ছে। এগুলো সমাধানের চেষ্টা করব। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে আমরা মস্তবড় সুযোগ পেয়েছি। এটাকে যেন হারিয়ে না ফেলি। আমরাও সেটা চেষ্টা করব। ভবিষ্যতে যারা আসবে তারাও আশা করি চেষ্টা করবে। পথটা যেন আমরা সৃষ্টি করে দিই এই পথ সৃষ্টির ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনী একটা মস্তবড় ভূমিকা পালন করতে পারে।’

সামগ্রিক বিশ্লেষণে এটি সুস্পষ্ট যে, সমাজ ব্যবস্থাকে গতিশীল রাখার প্রয়োজনে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, অনস্বীকার্যও বটে। সৎযোগ্যদক্ষদেশপ্রেমিক পুলিশবাহিনীর সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনার ওপর দেশের আইনশৃঙ্খলা নির্ভার থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাঠামোর বাইরে গিয়ে অনেকক্ষেত্রে পুলিশকে মানবিক আচরণে উৎকৃষ্ট হতে হয়। দলনিরপেক্ষবস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মবর্ণলিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের প্রতি উদার ও নীতি নৈতিকতায় পরিপুষ্ট ন্যায়ভিত্তিক ব্যবহারই পুলিশের ভাবমূর্তিকে প্রকৃত অর্থেই সমুজ্জ্বল করে তুলে। অতীতের সমস্ত ভুলত্রুটি আমলে নিয়ে বর্তমান ও আগামীতে পুলিশ সমহিমায় মর্যাদাসীন হোকএটিই সমাজের প্রত্যাশিত জোরালো দাবি।

লেখক

শিক্ষাবিদ, সমাজঅপরাধবিজ্ঞানী

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধএলাকা ময়লার ভাগাড়ে আগুন ধোঁয়ায় দূষণ পরিবেশ