নিরাপত্তা সতর্কতা হিসেবে নেয়া পদক্ষেপ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের ‘কষ্ট’ বাড়িয়ে দিয়েছে। অ্যারাইভাল সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখায় সব যাত্রীকে নামতে হচ্ছে পার্কিং এরিয়ায়। ওখান থেকে অসুস্থ মানুষজনকে হাঁটিয়ে এবং ব্যাগ–ব্যাগেজ টেনে বিমানবন্দরের টার্মিনালে প্রবেশ করতে অনেকের অবস্থা কাহিল। অপরদিকে বিদেশ ফেরত যাত্রীদেরও একইভাবে ‘নজিরবিহীন’ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিমানবন্দরের ডিজাইনে বিষয়টি ‘অন্যভাবে’ থাকায় যাত্রীদের ভোগান্তি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
অবশ্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট এবং সতর্কতার প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা হিসেবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ায় যাত্রীদেরকে কিছুটা কষ্টে পড়তে হয়েছে। বিষয়টি সাময়িক উল্লেখ করে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরিস্থিতি অনুকূলে এলে বিষয়টি তুলে দেয়া হবে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৯৭২ সালে এটিকে বাণিজ্যিক অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশ বিমান এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স এখানে ফ্লাইট অপারেট করতে থাকে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ বিমান মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই ও সৌদি আরবে যাত্রী পরিবহন শুরু করলে বিমানবন্দরটি ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপ নেয়। তবে বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বীকৃতি লাভ করে প্রায় ২৩ বছর পর ২০১৩ সালে।
এর আগে জাপানি সংস্থা জাইকার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৯৮ সালে বিমানবন্দরটির আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয়। ৫১.৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তৎকালীন প্রায় ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিমানবন্দরটির আধুনিকায়নের কাজ সম্পন্ন হয়। ২০০১ সালে চট্টগ্রাম এম এ হান্নন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামে নতুন অবয়বে যাত্রা শুরু করে বিমানবন্দরটি। পরবর্তীতে নাম পাল্টে করা হয় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
দিনে দিনে এই বিমানবন্দরের ব্যস্ততা বেড়েছে। বেড়েছে ফ্লাইট চলাচল এবং যাত্রী হ্যান্ডলিং। ২০২৪ সালে এই বিমানবন্দর ১৬ লাখ ৪১ হাজার ৬১১ জন যাত্রী এবং ১৮ হাজার ৭১৫টি ফ্লাইট অপারেট করে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ মিলিয়ে ৭ লাখ ১৬ হাজার ৪২১ জন যাত্রী হ্যান্ডলিং হয়েছে। ফ্লাইট চলাচল করেছে ১১ হাজার ৩০০টি। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজার থেকে ৫ হাজার যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেন। যাত্রীদের সাথে এক–দুজন করে মানুষ আসা–যাওয়া করলেও এই সংখ্যা দশ থেকে ১৫ হাজারে গিয়ে ঠেকে। বিপুল সংখ্যক মানুষের পাশাপাশি প্রচুর গাড়িও প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিমানবন্দর এলাকায় চলাচল করে।
যাত্রী এবং ফ্লাইট হ্যান্ডলিং বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আয় করেছে। গত অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয় হয় ২৭০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, যা এ বিমানবন্দরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছিল ২৩৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে রাজস্ব আয় প্রায় ৩৩ কোটি টাকা বৃদ্ধি পাওয়াকে বিমানবন্দরের কার্যক্রম বৃদ্ধির অন্যতম সূচক বলে সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।
যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাম্প্রতিক সময়ে বিমানবন্দরে যাত্রীদের ‘কষ্ট’ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে সূত্রগুলো বলেছে, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডিজাইনটি এমনভাবে করা, গাড়ি যাত্রীদের বহির্গমন গেটে নামিয়ে দিয়ে সামনের দিকে চলে ঘুরে বেরিয়ে যাবে। অপরদিকে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের অ্যারাইভাল গেট থেকে তুলে নিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করবে। যেসব গাড়ি অপেক্ষা করবে তাদেরকে নির্দিষ্ট পার্কিং এরিয়ায় গিয়ে অবস্থান করতে হবে।
কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে বিমানবন্দরে যাত্রী নিয়ে যাওয়া এবং বিদেশ ফেরত যাত্রীদের আনতে যাওয়া সব গাড়িকে পার্কিং এরিয়ায় প্রবেশ করানো হচ্ছে। প্রতিটি কার ও মাইক্রোবাস থেকে ৬০ টাকা এবং প্রতিটি সিএনজি টেঙি থেকে ২৫ টাকা পার্কিং চার্জ আদায় করা হচ্ছে। পার্কিং এরিয়াতে প্রবেশের রাস্তাটি সরু হওয়ায় সেখানে জটলা হচ্ছে।
বিদেশগামী যাত্রী যারা বছরের পর বছর বহির্গমন গেটে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে টার্মিনালে প্রবেশ করতেন তাদেরকে এখন পার্কিং এরিয়ায় নামতে হচ্ছে। ওখান থেকে ব্যাগ–ব্যাগেজ টেনে পায়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে টার্মিনালে। পার্কিং এরিয়ায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ায় লাগেজ নেয়া বা হাঁটায় সমস্যা হয়। অপরদিকে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদেরকেও অ্যারাইভাল গেট থেকে বের হয়ে লাগেজ টেনে পার্কিং এরিয়াতে এসে গাড়িতে চড়তে হচ্ছে। এক্ষেত্রে অসুস্থ, বয়স্ক এবং যাদের লাগেজ বেশি থাকে তাদের কষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বহু যাত্রী অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পার্কিং এরিয়ার ইজারাদারকে বাড়তি সুবিধা দেয়ার জন্যই নতুন এই নিয়ম চালু করা হয়েছে।
তবে বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম খলিল বলেন, বিষয়টি তা নয়। আসলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাজনিত কারণে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে একটি থ্রেট আসার পর গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার অংশগ্রহণে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকে উক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর একটি জায়গা। এখানে নিরাপত্তার বিষয়টি সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে হয়। কোনো অঘটন ঘটলে তা পুরো জাতির জন্য সংকটের কারণ হবে। তাই আমরা বাধ্য হয়ে বিমানবন্দরের সামনের রাস্তায় কোনো গাড়ি চলাচল করতে দিচ্ছি না।
যাত্রীদের কষ্টের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরাও বিষয়টি দেখছি, আমাদেরও খারাপ লাগে। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে এই কষ্ট সবাইকে মেনে নিতে হচ্ছে। বিষয়টিকে সাময়িক উল্লেখ করে তিনি বলেন, অচিরেই যাতে বিষয়টি স্বাভাবিক করে নেয়া যায় আমরা সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। দেশের স্বার্থে সাময়িক এই অসুবিধা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে মেনে নেয়ার জন্য যাত্রীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।











