বাকলিয়া বগারবিল শান্তিনগর বাজার রোড। এ সড়কের বিভিন্ন অংশে একপাশে রয়েছে চাক্তাই খাল। অপর পাশে রয়েছে দোকানপাট ও ঘরবাড়ি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চলাচল করে এ সড়ক দিয়ে। শিশুদেরও খেলতে এবং দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায় এ সড়কে। সেখানে খালপাড়ে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী বা রেলিং নেই। তাই সারা বছরই অসাবধানতাবশত পথচারী এবং শিশুদের খালে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি আছে। গত সোমবার ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ডুবে যায় সড়কটি। সড়ক ও খাল প্রায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ফলে সেদিন দুর্ঘটনার ঝুঁকি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়।
শুধু বগারবিল এলাকা নয়। শহরের খাল–নালার পাশে এমন অসংখ্য স্পট রয়েছে যেখানে নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। অর্থাৎ অরক্ষিত রয়েছে খাল–নালা। অনেক এলাকায় রেলিংবিহীন অনেক ব্রিজও রয়েছে। যেগুলোও জন যান ও জন চলাচলে ঝুুঁকিপূর্ণ।
নগরবাসী বলছেন, নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় তারা সবসময় দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে আছেন। ঘনিয়ে আসছে বর্ষা। তাই দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে দাবি করে তারা বলছেন, বর্ষার সময় অরক্ষিত খাল–নালায় পড়ে প্রাণহানি ঘটার শঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে তিন সংস্থার ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে কোনো প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) শহরের আভ্যন্তরীণ খাল–নালার পাড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়ার বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত নেই। ফলে এ খাতে আলাদা কোনো বরাদ্দও নেই প্রকল্পে। তাই প্রকল্পগুলোর আওতায় খাল–নালার পাড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ খুব বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে না।
অবশ্য ঝুঁকি আছে এমন অনেক জায়গায় স্ব উদ্যোগে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের আওতায় এ বেষ্টনী দেয়া হয়। কিছু কিছু জায়গায় চসিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও স্ল্যাব দিয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাাবি করেছেন নগরবাসী।
নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় অরক্ষিত খাল নালায় পড়ে প্রতি বছর ঘটছে প্রাণহানি। গত চার বছরে খাল–নালায় পড়ে মারা যান ৯ জন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে মারা যান দুইজন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে খাল–নালায় প্রাণহানির জন্য চসিক ও সিডিএ’কে দায়ী করা হয়। এছাড়া নালায় পড়ে মৃত্যুর জন্য চসিক ও সিডিএ’র চরম অবহেলা দাবি করে সিডিএ চেয়ারম্যান ও চসিক প্রধান নির্বাহীসহ ১৩ জনকে ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছিল ‘চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ (সিসিবি ফাউন্ডেশন)।
চার প্রকল্পে রেলিংয়ের বরাদ্দ নেই : সিডিএ’র ৮ হাজার ৬২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকার ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনর্খনন, সমপ্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগাপ্রকল্প এবং ২ হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ শীর্ষক দুটি প্রকল্পের কাজ চলছে।
এছাড়া চসিকের রয়েছে এক হাজার ৩৬২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ‘নগরের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন’ শীর্ষ প্রকল্প এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক হাজার ৬২০ কোটি টাকার ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলছে। তিন সংস্থার এ চার প্রকল্পের কোনোটিতেই খালের পাড়ে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে রেলিং দেয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই।
নিরাপত্তা বেষ্টনী দেবে কে :
২০২২ সালের ৬ এপ্রিল জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্প নিয়ে চসিক–সিডিএ একটি সমন্বয় করে। ওই সভায় দুর্ঘটনা রোধে খাল ও নালার পাড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণে জোর দেয় দুই সংস্থা। এরপর কেটে গেছে দুই বছর। দুর্ঘটনারোধে শহরের শতভাগ খাল–নালার এখনো নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে পারেনি কোনো সংস্থা।
জানা গেছে, ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে নগরের ঝুঁকিপূর্ণ নালা–নর্দমা ও খালের একটি তালিকা করে চসিক। ওই তালিকা অনুযায়ী, নগরের ৪১ ওয়ার্ডে খাল–নালা রয়েছে এক হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া খালের পাড় রয়েছে ১৯ হাজার ২৩৪ মিটার। উন্মুক্ত নালা রয়েছে পাঁচ হাজার ৫২৭টি স্থানে। যেগুলো মরণফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত। এ তালিকা প্রণয়নের পর ২ বছর সাত মাস পার হলেও এখনো অরক্ষিত রয়েছে শহরের খাল–নালা।
চসিকের বর্জ্য স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি মোবারক আলী আজাদীকে বলেন, মেয়র মহোদয় কিছুদিন আগে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে প্রকৌশলীদের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে কাজ চলছে।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী শাহীন–উল–ইসলাম আজাদীকে বলেন, রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া হয়। এ বিষয়ে প্রকৌশল বিভাগের জোনগুলোতে নির্দেশনাও দেয়া আছে। তারা সনাক্ত করে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করবেন।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চসিকের এক হজার ৩৬২ কোটি টাকায় বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পটির পরিচালক ও চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফরহাদুল আলম আজাদীকে বলেন, প্রকল্পের আওতায় নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়ার পরিকল্পনা আছে।
নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে আট হাজার ৬৬২ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. ফেরদৌস আজাদীকে বলেন, রেলিং করাটা আমাদের প্রকল্পের পার্ট না। রেলিং করার জন্য আর্থিক যে সংশ্লেষ সেটা কোন জায়গা এড্রেস করা হয় নাই। এরপরও নাগরিক দায়বদ্ধতা থেকে দুর্ঘটনাপ্রবণ ডেঞ্জারাস খাল বা এলাকা যেখানে আছে সেখানে রেলিং দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু সবগুলো খালে রেলিং করতে পারব না। কারণ প্রজেক্টে এমন কোনো আইটেম নেই।
তিনি বলেন, চশমা খালের ২ নং গেইট থেকে মুরাদপুর, শীতলঝর্ণা খাল, খন্দকিয়া খালে দিচ্ছি। শহরের উত্তর এবং পূর্ব পাশে যেসব খাল আছে, যেগুলোর সাথে পাহাড়ের সংযোগ আছে বা যেসব খাল দিয়ে পাহাড়ি ঢল নামে সেখানেও রেলিং দিচ্ছি। কারণ পাহাড়ি ঢল নামলে স্রোত বেশি থাকে, তখন কেউ খালে পড়লে একেবারে হারিয়ে যেতে পারেন। চাক্তাই খালের যেসব এলাকায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা সেখানেও রেলিং দেয়ার পরিকল্পনা আছে। যেহেতু রেলিং দেয়া প্রকল্পভুক্ত না তাই প্রকল্পের শেষ সময়ে এসে ঝুঁকিপূর্ণ এরিয়া চিহ্নিত করে রেলিং দিব।
যিকরু হাবিবী ওয়াহিদ নামে এক বাসিন্দা বলেন, যেসব খালে নালায় পড়ে ইতোমধ্যে মানুষ মারা গেছে, সেসব খাল নালাসহ অন্যান্য খাল নালায় নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করতে না পারলে আসন্ন বর্ষায় সেসব উন্মুক্ত খাল নালা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই, শহরের উন্মুক্ত সকল নালা খালে দ্রুত সময়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
চার বছরে ৯ প্রাণহানি :
নগরে খাল–নালায় পড়ে গত চার বছরে মারা গেছে ৯ জন। এর মধ্যে গত ২৭ মে আছাদগঞ্জ শুটকি পল্লী এলাকায় কলাবাগিচা খালে পড়ে মারা যান ২৭ বছর বয়সী তরুণ আজিজুল হাকিম ইমন। একইদিন চান্দগাঁও থানার একটি ড্রেনে পড়ে যায় ১২ বছরের শিশু মনির হোসেন। একদিন পর তার মরদেহ পাওয়া যায়।
নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাবে ২০২১ সালে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় পাঁচ জন মারা যান। এর মধ্যে ৬ ডিসেম্বর ষোলশহর এলাকায় চশমা খালে তলিয়ে যায় শিশু মো. কামাল উদ্দিন (১২)। তিন দিন পর নগরের মির্জা খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২৫ আগস্ট চশমা খালের মুরাদপুরে পড়ে নিখোঁজ হন সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ। গতকাল পর্যন্ত তার খোঁজ মিলেনি। ২৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে আগ্রাবাদে নালায় পড়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সেহেরিন মাহবুব সাদিয়া। তারও আগে ৩০ জুন নগরের মেয়র গলি এলাকায় চশমা খালে পড়ে অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রী মারা যান। একই বছর চান্দগাঁওয়ে নালায় সিএনজি পড়ে গেলেও প্রাণহানি ঘটেনি।
এছাড়া ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়ায় একটি নালায় পড়ে নিখোঁজ হয় দেড় বছরের শিশু ইয়াছিন আরাফাত। এর ১৬ ঘণ্টা পর নালার আবর্জনার নিচ থেকে ইয়াছিনের মরদেহ উদ্ধার হয়। একই বছরের ৭ আগস্ট ১ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামিয়া হাটসংলগ্ন বাদামতলা এলাকায় বৃষ্টির মধ্যে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী নিপা পালিতের (২০)।