নিভে গেল ‘আকাশ প্রদীপ’

করোনার সাথে ২৭ দিনের লড়াই শেষ চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর, যাঁর গানের কণ্ঠে লজ্জা পেত কোকিলও

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে,/ আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে/ ব্যথার বাদলে যায় ছেয়ে… বয়ে চলে আঁধি আর রাত্রি/ আমি চলি দিশাহীন যাত্রী/দূর অজানার পারে/ আকুল আশার খেয়া বেয়ে।।
ব্যথার বাদলে ছেয়ে গেল আকাশ-বাতাস। এই ব্যথা সুরসম্রাজ্ঞী ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকরকে হারানোর ব্যথা। তাঁর প্রয়াণে শোকে স্তব্ধ ভারতীয় সংগীত জগৎ। ভারতবাসীর কাছে তিনি
ছিলেন গানের পাখি নাইটিংগেল, কেউবা বলতেন ‘স্বরা কোকিল’। লন্ডনের রয়েল আলবার্ট হলে এক লাইভ প্রোগ্রামে উপস্থাপিকা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘এখন আপনাদের সামনে আসছে এমন এক শিল্পী যার কণ্ঠ শুনে কোকিলও লজ্জা পায়।’
সেই গানের পাখি গতকাল রোববার সকালে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ২৭ দিন সেখানে ভর্তি ছিলেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে ১১ জানুয়ারি ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। করোনামুক্ত হওয়ার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। অবস্থার অবনতি হলে শনিবার তাঁকে আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না।
লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে টুইট করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর প্রয়াণে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তাঁর মৃত্যুতে ভারতে দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই সংগীত শিল্পীর সম্মানে ভারতের জাতীয় পতাকা দুদিন অর্ধনমিত রাখা হবে। শোক প্রকাশ করে আজ অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। আগামী ১৫ দিন রাজ্যে বাজবে লতার গাওয়া গান। খবর বিডিনিউজ, বিবিসি বাংলা ও বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার।
লতা মঙ্গেশকরের অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষ সেখানেই এই কোকিলকণ্ঠীর দাহকাজ সম্পন্ন হয়। তাঁর বড় ভাইয়ের ছেলে আদিত্য মঙ্গেশকর তাঁর মুখাগ্নি করেন।
অভিনয় থেকে পেশা জীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে লতা ভারতের কিংবদন্তী গায়িকা হয়ে উঠেন। তিনি ছিলেন এমন একজন প্লেব্যাক গায়িকা, যিনি ভারতের চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গীতে অন্যরকম এক মাত্রা এনে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে হাজারের বেশি সিনেমায় গান করেছেন। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাতেও গান করেছেন।
গত শতকের চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করা লতা অল্প সময়েই হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য একটি নাম। গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার বলেছিলেন, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো মানেই যেমন চিত্রকলা, শেঙপিয়র মানেই যেমন ইংরেজি সাহিত্য, তেমনই ভারতীয় সিনেমার গান মানেই লতা মঙ্গেশকর।
মধ্য ভারতের শহর ইন্দোরে ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর পিতা ছিলেন একজন গায়ক, থিয়েটারের অভিনেতা ও মারাঠি ভাষায় গীতিনাট্যের প্রযোজনা করতেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর অন্য ভাইবোনেরাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন এবং তাঁরাও ভারতের নাম করা গায়ক-গায়িকা হয়েছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান। আগে নাম ছিল হেমা। তবে মৃত বড় বোনের নাম লতিকা হওয়ায় তার নাম হয়ে যায় লতা।
একটি সাক্ষাৎকারে লতা বলেছিলেন, তাঁর পরিবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করত এবং চলচ্চিত্রের গান বাড়িতে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না। তিনি কখনোই প্রথাগত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি। একজন গৃহকর্মী তাকে মারাঠি বর্ণপরিচয় শিখিয়েছেন। স্থানীয় একজন পুরোহিত সংস্কৃত শেখান। আত্মীয়স্বজন ও শিক্ষকরা বাড়িতে এসে তাকে অন্যান্য বিষয় শেখাতেন। কিন্তু তাদের জন্য সময়টা কঠিন হয়ে ওঠে, যখন তারা বাবা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ফলে তিনি চলচ্চিত্র আর তার থিয়েটার কোম্পানি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। মহারাষ্ট্রের সাঙ্গলিতে তাদের পারিবারিক বাসস্থানটি নিলাম হয়ে গেলে পরিবারটি পশ্চিমের শহর পুনেতে চলে আসতে বাধ্য হয়। পিতার মৃত্যুর পর পরিবারটি মুম্বাই শহরে চলে আসে।
১৯৪০-এর দশকে চলচ্চিত্রে তত বেশি গানের সুযোগ না থাকায় তরুণী লতা রোজগারের জন্য অভিনয় করতে শুরু করেন। তিনি প্রায় আটটি মারাঠি ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৪৩ সালে মারাঠি চলচ্চিত্র ‘গজাবাউ’তে তিনি ‘কিছু কথা, কিছু শব্দ’ শিরোনামের একটি গান গেয়েছেন, যা ছিল চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া প্রথম গান। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রতি মাসে আয় হতো দুইশ রূপি।
এক সাক্ষাৎকারে লতা মুঙ্গেশকর বলেছিলেন, মেকআপ, লাইট এগুলো কখনোই আমার ভালো লাগেনি। মানুষজন আপনাকে আদেশ দিচ্ছে, এই কথা বলো, ওই কথা বলো, আমার খুব অস্বস্তি লাগত।
তখন কেএল সায়গল, শামশাদ বেগম ও নুরজাহানদের যুগ। শুরুর দিকে লতা মঙ্গেশকরকে শুনতে হয়েছিল, তাঁর কণ্ঠস্বর একটু বেশিই পাতলা। তাঁকে প্রথম সুযোগ দেন মাস্টার গুলাম হায়দার। তাঁর পরেই আসে ‘মহল’-এর সেই বিখ্যাত গান ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। সেই সিনেমা ১৬ বছরের মধুবালা ও ২০ বছরের লতা, দুজনের জন্যই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৯ সালে মহল চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার পর থেকে তিনি সবার নজরে চলে আসেন। পরবর্তী চার দশক ধরে তিনি মনে রাখার মতো এবং জনপ্রিয় অনেক গান গেয়েছেন। এসবের মধ্যে আছে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পাকিজা, মাজবর, আওয়ারা, মুঘল ই আজম, শ্রী ৪২০, আরাধনা ও দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গের মতো সিনেমা, যেটি রেকর্ড বিশ বছর ধরে টানা চলেছে।
চীনের সঙ্গে ভারতের ১৯৬২ সালের যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মরণে একটি জনসভায় গভীর আবেগে যখন তিনি ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কে লোগো’ (ও আমার দেশের মানুষ) গাইছিলেন, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পড়ে।
বলিউডের সকল বিখ্যাত গায়কের সঙ্গে তিনি গান গেয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার। সেই সঙ্গে বলিউডের শীর্ষ সকল পরিচালকের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন, যাদের মধ্যে আছেন রাজ কাপুর ও গুরু দত্ত থেকে শুরু করে মনি রত্নম, করন জোহর।
লতা বলতেন, আমি হচ্ছি একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। আমি জানি কীভাবে লড়াই করতে হয়। আমি কখনো কাউকে ভয় পাইনি। আমি খানিকটা ভয়হীন ধরনের মানুষ।
গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার তার সুরেলা কণ্ঠ ও আন্তরিক গান গাওয়াকে বর্ণনা করেছেন ‘এতটাই বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার যেন স্ফটিকের সবচেয়ে সেরা মুক্তো’।
চলচ্চিত্রের গানের বাইরে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে লতা মঙ্গেশকরের পছন্দ ছিল ক্রিকেট, গাড়ি, কুকুর, স্লট মেশিনে। তিনি মোজার্ট, বিথোভেন, চোপিন, নাট কিং কোল, বিটলস, বারব্রা স্ট্রেইস্যান্ড ও হ্যারি বেলাফন্টের সংগীত শুনতে পছন্দ করতেন। মঞ্চে মার্লিন ডিয়েট্রিচের গান গাওয়া দেখতে গিয়েছিলেন ও বার্গম্যানের থিয়েটার দেখতে ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে রান্না করা ও রোলেইফ্লেঙ ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা তাঁর শখের অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রে ছুটি কাটানোর সময় তিনি লাস ভেগাসে সারারাত ধরে স্লট মেশিনে খেলতে ভালোবাসতেন।
মঙ্গেশকরকে অনেক সময় তাঁর বন্ধু সেতার মাস্টার রবি শঙ্করের স্টুডিওতে দেখা যেত, যেখানে তিনি বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ১৯৭৯ সালে তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি রয়্যাল আলবার্ট হলে ওরেন অর্কেস্ট্রার সঙ্গে সঙ্গীতানুষ্ঠান করেছেন।
বাংলাদেশের একাধিক প্রজন্মের কাছেও লতার কণ্ঠ স্বপ্নের মতো। বাংলা সিনেমায় প্রায় ২০০ গান রয়েছে লতার। তার কণ্ঠের ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যা রে উড়ে যারে পাখি’, ‘বলছি তোমার কানে’, ‘চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়’ এর মতো বহু গান এ দেশের মানুষ মনে রাখবে আরও বহু দিন।
প্রয়োজন অনুযায়ী গায়কী আর কণ্ঠ বদলে নেওয়ার অসাধারণ দক্ষতা ছিল লতার। একই সিনেমায় তিনি তিন নায়িকার গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। লতাকে ভেবেই ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’য়ের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন রাজ কাপুর।
২০০১ সালে লতা মঙ্গেশকর ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ভারতরত্ন অর্জন করেন। ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৯ সালেই পদ্মভূষণে ভূষিত করেছিল ভারত সরকার। ১৯৯৯ সালে তিনি পদ্মবিভূষণ, ২০০১ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন দেওয়া হয় তাঁকে।
শেষ যাত্রা : লতা মঙ্গেশকরের বোন ভারতের সংগীত জগতের আরেক কিংবদন্তি আশা ভোশলে, উষা মঙ্গেশকরসহ মঙ্গেশকর পরিবারের সদস্যরা শিবাজি পার্কের পথে তার সঙ্গী হন। লতা মঙ্গেশকরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক, বলিউডের তারকারা একে একে শিবাজি পার্কে যান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শিবাজি পার্কে গিয়ে লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানান।
সবার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে ভারতের তিন বাহিনীর সদস্যরা লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানান এবং তাঁর পরিবারের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন। তার পরপরই হিন্দু রীতি মেনে দাহকাজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুনে চালু হচ্ছে পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল
পরবর্তী নিবন্ধআজ থেকে কার্যকর সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ৮ টাকা