মৃত্যু মাত্রই আমরা জন্মি সমুদ্রের পানে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখির মতো, এই এলো বুঝি এই চলে গেল। মাঝখানে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া ক্ষণিক সময়টুকু। সময়ের সমুদ্রের মাঝে আমাদের বসবাস অথচ জীবনটা যে সমুদ্রের ঢেউয়ের জলরাশির মতো, শরতের ঝরে পড়া শিউলি ফুলের মতো, হেমন্তে কৃষকের কাঁধে নৃত্য করা সোনালি ধানের গোছা থেকে ঝরে পড়া ফসলের মতো। আমরা অনুভব করতে পারি না। মানুষের জীবনটা যেন এক শস্যক্ষেত্র। কবি বোধহয় এজন্য বলেছিলেন, ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের মানুষের সাথে তায় হয় নাকো দেখা’। আসলে মানুষ তাঁর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন হাজার বছর। মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু স্মৃতির মৃত্যু হয় না। তা ফিরে আসে বারবার মনকে নাড়া দিয়ে যায়, তেমনই একজন সত্যিকারের সৎ সহজ সরল বিনয়ী প্রকৃতি মানুষ ছিলেন আহাম্মদ কবীর।
সৃজনশীল ও গবেষণাধর্মী নিজ শিকড়ের ইতিহাস নিয়ে গত এক যুগ ধরে সফলতার সাথে পরিশ্রম করে রচনা করলেন সুচক্রদণ্ডী গ্রামের ইতিহাস। বইটি করতে গিয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে যেভাবে ডুবুরিরা হীরা, মানিক জহরত মণি মুক্তা কুড়িয়ে আনেন, ঠিক সেভাবে নিজ গ্রামের কে কোথায় আছেন, সরেজমিনে গিয়ে ইতিহাসের সত্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন তা আবার গবেষণা করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসজ্ঞ, লেখক ও নাট্যকার, রাজনীতিবিদ পটিয়া সুচক্রদণ্ডী গ্রামের কৃতী পুরুষ আহাম্মদ কবীর।
আহাম্মদ কবীর ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ সালে সুচক্রদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল মালেক, মাতা সুফিয়া খাতুন। পড়ালেখার হাতে প্রথমে সুচক্রদণ্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরে শশাংকমালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী। দক্ষিণ ভূর্ষি স্কুল থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন পটিয়া কলেজে। ১৯৭৯ সালে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ১৯৮৩ সালে অনার্স এবং ১৯৮৫ সালে মাস্টার্স পাশ করেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি রাজনীতি শুরু করেন। ট্রেড ইউনিয়ন, মানবাধিকার, শিক্ষা সংস্কৃতি শিল্প প্রকৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন দেশবিদেশে। কবীর ভাই বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন/গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টির কেন্দ্রীয় পরিষদের সক্রিয় সদস্য এবং চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সাদা মনের নির্ভৃতচারী সদালাপী মানুষটি ১৯৮১ সালে পাহাড়তলীস্থ কিশোর সংঘের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। একসময় গল্প, নাটক, গবেষণা গ্রন্থ, গীত রচনা ইত্যাদি তাঁর প্রিয় বিষয় হয়ে উঠে। একুশে পদক প্রাপ্ত ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান স্যারের নিকট ভাষা বিজ্ঞান পড়ে ভাষা নিয়ে অনুসন্ধান ও শব্দকোষ রচনায় নিরলস কাজ করেছেন। স্কুলবেলা থেকে কবীর ভাই লিখতেন। তাঁর রচিত গল্প সংখ্যা ১০ টি। নাটক ৪৩ টি। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা নাটকের মধ্যে ছিল– শতাব্দির জনপদ, আবারো পথচারী, বাঁচার লড়াই, দৃষ্টি নিয়ে দেখা, অবরোধ, যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ নয়, ফুলজান, মনলোক, বীরাঙ্গনা, সোনালী দিন, ৩২ ধানমন্ডি, নালিশ, চাঁদ মনসার কাহন, আমরা পুতুল নই, বেদনার বিওগল ইত্যাদি। কবীর ভাইয়ের কিছু নাটক অপ্রদর্শিত ছিল, সাইনবোর্ড, একা ও এক সঙ্গে, শিখা অনিবার্ণ, রীত বদল, মেগা অফার, দামামা, আইউ, বইউ , কথা কই, জানোয়ার ইত্যাদি।
তাঁর সম্পদনায় ত্রৈমাসিক পত্রিকার নাম ছিল ‘পত্রবীজ’। পটিয়ার নবীন ও প্রবীণ লেখকদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেন ‘পটিয়া সাহিত্য সভা’। সাহিত্যসভার মাধ্যমে তিনি আমাকে খুব কাছের আপন করে নিলেন।
আমার দেখা কবীর ভাইয়ের সেরা কাজ ছিল, ইতিহাসের খসড়া প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সুচক্রদণ্ডীর ইতিহাস’ বইটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। ১২ বছরের গবেষণার ফসল ‘সুচক্রদণ্ডীর ইতিহাস’। বাংলাদেশে কোনো গ্রামের উপর এতো সুন্দর ইতিহাস কেউ লিখেছেন কিনা সন্দেহ আছে।
গত ২৮ মার্চ ২০২৩ পবিত্র রমজান মাসে মহান সৃষ্টিকর্তার ডাকে সারা দিয়ে প্রিয় কবীর ভাই না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু স্মৃতির মৃত্যু হয় না। তা ফিরে আসে বারবার মনকে নাড়া দিয়ে যায়, তেমনই একজন সত্যিকারের সৎ সহজ সরল বিনয়ী প্রকৃতি মানুষ ছিলেন কবীর ভাই। তিনি ছিলেন, একজন সদালাপী হাস্যোজ্জ্বল নিরহংকারী প্রাণবন্ত এক ভালোমানুষের মডেল। যাঁর পা থেকে আপাদমস্তক পর্যন্ত প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য এক জীবন্ত ইতিহাসের কারিগর। যিনি প্রতিনিয়ত বইয়ের দুনিয়ায় ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন। সকলে তাঁকে পছন্দ করতেন, সম্মান করতেন। কখনো কারো সাথে কটুবাক্য বলতেন না। স্পষ্টবাদী মানুষটি চোখের সামনে অন্যায় দেখলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন। সাড়ে তিন হাত মাটির কুঠুরিতে চলে গেলে বুঝা যায়, মানুষের ভালোবাসা, ভালো কর্মটি যেন জলজোছনার মতো জলছবি হয়ে ভেসে বেড়ায় মানুষের হৃদয়ে। আমার কাছে আজও মনে হয় তিনি কাঁধে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে সবুজ শ্যামল সুচক্রদণ্ডী গ্রামের মাঠে প্রকৃতি বিছিয়ে দেওয়া সবুজ গালিচায় পায়চারি করছেন। চেয়ারে বসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে লিখছেন। চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে মুচকি হাসিমাখা প্রিয় মুখখানি।
পরিশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করি তিনি যেন আহাম্মদ কবীর ভাইকে জান্নাতের উচ্চ মোকাম দান করুন। জান্নাতের বাগানের ফুল ফুটিয়ে রাখেন–আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।











