নিপীড়নের জেরে আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা

আটক প্রধান অভিযুক্ত আশরাফুলের স্বীকারোক্তি পুলিশের বক্তব্যের সাথে পরিবারের দ্বিমত, মামলা

কক্সবাজার প্রতিনিধি | বুধবার , ২৩ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

যৌন নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুদ্দিনকে (৪৫) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত হাফেজ আশরাফুল ইসলামকে (১৮) সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় টেকনাফের হোয়াইক্যং থেকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে এ তথ্য জানান। তবে নিহতের পরিবার ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও প্রশ্নবোধক’ বলে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, সিসিটিভির ফুটেজে শনাক্ত হওয়া আশরাফুল ইসলাম নামের ছেলেটি একাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। খুব বেশি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে তরুণটি এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছে। পরে রাত ১০১১টার পর শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে অনুসরণ করে টেকনাফের হোয়াইক্যং থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি, মোবাইল ফোন ও মোটরসাইকেল আসামির দেখানো নর্দমা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

সাইফুদ্দিনের শরীরে অন্যান্য আঘাতের চিহ্ন ছাড়াও ১৭টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে এবং হত্যাকাণ্ডে একজনই জড়িত ছিলেন বলে দাবি করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার আশরাফুল ইসলাম কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলী ইসলামপুর এলাকার মোহাম্মদ হাশেমের ছেলে। তিনি সেখানকার একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। তার বিরুদ্ধে গতকাল কক্সবাজার সদর থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু করা হয়েছে। এদিকে সাইফুদ্দিন খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে। সদর থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম গত রাতে বলেন, সাইফুদ্দিনের বাবা আবুল বশর বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। এতে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।

অবশ্য মামলার আগে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার আশরাফুল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আসাদ উদ্দিন মো. আসিফের আদালতে এই জবানবন্দি দেন।

আশরাফুলকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার জানান, আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুদ্দিনের সাথে আশরাফুলের পরিচয় হয় সপ্তাহখানেক আগে সাইফুদ্দিনের চাচাতো শ্যালক নয়নের মাধ্যমে। এরপর দুজনের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে মোবাইল ফোন লেনদেন হয়। গত রবিবার সাইফুদ্দিন নিজের মোটরসাইকেলে আশরাফুলকে নিয়ে শহরে ঘোরাঘুরি করেন। এরপর বিকালে তারা বাজারঘাটায় গিয়ে মদ ও ফলমূল কিনে সানমুন হোটেলের ২০৮ নম্বর কক্ষে আসেন। এরপর ওই কক্ষে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ সংঘটিত হয় এবং সেই ঘটনা ভিডিও ধারণ করে রাখা হয়। ঘটনার কিছুক্ষণ পর সাইফুদ্দিন আশরাফুলকে নিয়ে হোটেল কক্ষ থেকে বের হয়ে যান এবং নিজের মোটরসাইকেলে করে বাজারঘাটায় তাকে নামিয়ে দিয়ে আসেন। এ সময় আশরাফুলের হাতে ১শ টাকার একটি নোটও দেন সাইফুদ্দিন।

পুলিশ সুপার জানান, এর ঘন্টাখানেক পর সাইফুদ্দিন ফোন করে আশরাফুলকে আবারো হোটেলকক্ষে ডেকে পাঠান এবং ফের একই কর্মে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় আশরাফুল তাকে বাধা দিলে তার গলা চেপে ধরেন সাইফুদ্দিন। এক পর্যায়ে আশরাফুল ধাক্কা দিয়ে সাইফুদ্দিনকে ফেলে দেয় এবং তার সাথে থাকা ছুরি নিয়ে উপর্যুপুরি আঘাত করে। এ সময় সাইফুদ্দিনের গোঙাানির শব্দ যাতে কক্ষের বাইরে না যায় সেজন্য বালিশ দিয়ে তার মুখ চেপে ধরা হয়। তার প্যান্টের বেল্ট খুলে হাতপা বেঁধে ফেলা হয়। ঘটনার পর শরীরের রক্ত ধুয়েমুছে কক্ষ থেকে বাইরে যাওয়ার পর রক্তের দাগ দেখে আবারও ফিরে আসে আশরাফুল। এরপর ভালো করে হাতপা ধুয়ে পালিয়ে যায়। পরদিন সোমবার সকালে সাইফুদ্দিন হত্যার কথা জানা যায়।

ঘটনার তদন্ত মাত্র শুরু হয়েছে মন্তব্য করে পুলিশ সুপার বলেন, এর বাইরেও আরও কিছু থাকতে পারে, আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। তার পেছনে কারা কিংবা সম্মিলিতভাবে এর পেছনে কিছু আছে কিনা। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। এটা আশরাফুল স্বীকার করেছেন। একে ভিত্তি ধরে চারপাশে আরও কিছু থাকলে সেটাও আমরা খতিয়ে দেখব নিশ্চয়ই।

নিহত সাইফুদ্দিন (৪৫) শহরের ঘোনারপাড়া ৯ নং ওয়ার্ডের অবসরপ্রাপ্ত আনসার কমান্ডার আবুল বশরের ছেলে ও কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

পুলিশের বক্তব্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও প্রশ্নবোধক : পুলিশের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে সাইফুদ্দিনের পরিবার। তারা এই বক্তব্যকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও প্রশ্নবোধক বলে মন্তব্য করেছে। সাইফুদ্দিনের ছোট ভাই মহিউদ্দিন মহিম সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ সুপার গ্রেপ্তার আশরাফুল ইসলামের বরাত দিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে আমি এবং আমার পরিবার একমত নই। আমরা এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি।

খুনের যথাযথ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ট তদন্ত করে প্রকৃত কারণ উদঘাটন করার জন্য পুলিশ প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, আশরাফুলের একার পক্ষে আমার ভাইকে খুন করার দাবিটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোনো ব্যক্তি বিশেষ কিংবা মহল আশরাফুলকে দিয়ে পরিকল্পনা মতো খুনের ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে চেষ্টা করছে। আমার নিষ্পাপ ভাইয়ের চরিত্র হননের খেলায় মেতে উঠেছে বলে মনে করি। ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বিশ্লেষণ করে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত পরিকল্পিত। গ্রেপ্তার আসামি নিঃসন্দেহে একজন পেশাদার খুনি।

মাহিম বলেন, সাইফুদ্দিনকে চেতনানাশক কিছু দ্রব্য খাওয়ানোর পর অবচেতন করে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আশরাফুল মাদ্রাসার ছাত্র এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গি। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাচ্ছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাহাড় কেটে প্লট তৈরির চেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধফটিকছড়িতে শিক্ষার্থীকে কারের ধাক্কা, সহপাঠীদের সড়ক অবরোধ