পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে নানা অজুহাত অসাধু ব্যবসায়ীদের। তারা করোনা, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, ব্যাংকে এলসি খোলা নিয়ে জটিলতা–এ ধরনের নানা অজুহাত দেখিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। এ ধরনের সিন্ডিকেটের হাতেই জিম্মি সাধারণ ক্রেতারা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কৌশল পালটেছে। আগে রোজা শুরু হলে দাম বাড়ত। তখন চারদিক থেকে রব উঠত। সরকারের তৎপরতা আরও বেড়ে যেত। ফলে সিন্ডিকেট বেশিদূর যেতে পারত না। এসব কারণে এখন তারা রোজা ছাড়াও নানা সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে থাকে। ব্যবসায়ীদের কৌশলের কারণে ক্রেতাদের সাবধান হতে বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা অনুরোধ জানিয়েছেন, কেউ যেন একসঙ্গে অনেক বেশি পণ্য না কেনে। তাদের মতে, ক্রেতারা সাবধান হলেও এখন থেকেই কঠোরভাবে বাজার তদারকি করতে হবে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দাসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। প্রতিটি ডিমের দাম ১৪ থেকে ১৫ টাকা। পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫–২০ টাকা। মাছ–মাংসে হাত দেওয়ার উপায় নেই। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে ‘আগুনে হাত পুড়ে’ যাওয়ার মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ভোক্তার জন্য বাজার করা আর্থিক ও মানসিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাদের আলুভর্তা ও ডিম–ডাল দিয়ে কোনোভাবে দুবেলা চলত, তারাও এখন প্রায় নিরুপায়। বাড়তি চাল–ডালের দামের কারণে ডাল–ভাত জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন অধিকাংশ ভোক্তা। পুষ্টির চিন্তা কেউ মাথায় আনতে পারছেন না। এছাড়া সরকারি–বেসরকারি সব ধরনের সেবার দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় খরচ বেড়েই চলেছে। কিন্তু আয় বাড়ছে না। এতে অধিকাংশ ভোক্তার সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।
এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে স্বল্পআয়ের মানুষের নিত্যদিনের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। সব মিলে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম মেটাতে ভোক্তার হাঁসফাঁস অবস্থা। অনেক ক্রেতা অপরিহার্য পণ্য ছাড়া অন্য কিছু কেনা বাদ দিয়েছেন। অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার খাবারের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে শরীরে পুষ্টি ঘাটতিও দেখা দিচ্ছে।
ভোক্তারা বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার তো কোনো কারণ দেখছি না। খবরের কাগজে দেখলাম, দেশে চাল–ডাল–তেলের যথেষ্ট মজুদ আছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম কম। তাহলে দাম বাড়ছে কেন? তাঁরা বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে সংসার চালানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণে দেশের মধ্য এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি বড় চাপ তৈরি হয়েছে। বাজারে সব ধরনের চালের দামই গত কয়েক সপ্তাহে বেড়েছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোরভাবে সতর্ক করা হলেও পণ্যমূল্য ঠিকই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকরের মনিটরিং কার্যক্রম আরও জোরদার করতে সব জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়াও হয়েছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, প্রকৃতপক্ষে, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বেশ কয়েকটি নিত্যপণের দাম বেড়ে যায় বলেই আমরা দেখে আসছি। তাই সেই পণ্যগুলোর দাম বাড়ার আগেই সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারত। এর চেয়েও বেশি হতাশাজনক বিষয় হলো, কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে এই দাম বৃদ্ধিকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলেও মনে হয়–এর ফলে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের জন্য ভোক্তাদের শোষণের চেষ্টা করে।
উদাহরণ হিসেবে, পেঁয়াজের দামের কথা বলা যায়। ব্যবসায়ীরা এর মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ভারতের আবহাওয়া বিপর্যয়কে দায়ী করার চেষ্টা করছেন। তবে, মজার ব্যাপার হলো– পেঁয়াজের ওপর থেকে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের ঠিক পরেই প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম কমতে থাকে। যদিও ভারত থেকে স্থলবন্দর হয়ে পেঁয়াজ আসতে কমপক্ষে ৪–৫ দিন সময় লাগে। যার অর্থ, কম শুল্কে আমদানি করার আগেই তারা দেশের বাজারে দাম কমিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের কিছু পণ্যের বর্ধিত মূল্যের কারণে ব্যবসায়ীরা কীভাবে স্থানীয় বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে এটা তার স্পষ্ট উদাহরণ।
সরকার বারবার সিন্ডিকেটের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে বলেছে, যে কোনো সংকটের সুযোগ নিয়ে তারা দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এই ধরনের সিন্ডিকেট নির্মূলে কী করছে সরকার, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ অস্পষ্ট। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি এবং এই ধরনের ব্যর্থতার ফল ভোক্তাদেরই বহন করতে হয়েছে। আসলে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল ও মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই। এ জন্য সরকারের যথেষ্ট জনবল ও সম্পদ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যার কারণে যদি দাম বাড়ার আশঙ্কা থাকে, সরকারের উচিত সেসব সমস্যা মোকাবিলায় বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া।