নিজের লেখা এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সব্যসাচী লেখক চৌধুরী জহুরুল হক মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন বলে মন্তব্য করেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব, এম এ মালেক। তিনি বলেন, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি, মেধা, মনন ও নতুন উদ্ভাবনী কৌশল দিয়ে চৌধুরী জহুরুল হক সাহিত্যে এক নবীন মাত্রা সঞ্চার করেন। বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে চৌধুরী জহুরুল হক একজন নিরীক্ষাধর্মী সৃজনশীল শিল্পস্রষ্টা। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও ছিল অনুকরণীয়। এসময় যে উদ্দেশ্যে চৌধুরী জহুরুল হক সাহিত্যকর্ম করেছেন তা মনে রাখলেই তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক স্মরণসন্ধ্যা–২০২৫ এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। নাট্যমঞ্চ চট্টগ্রাম–এর উদ্যোগে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারিতে স্মরণসন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্মারক বক্তা ছিলেন কবি হাফিজ রশিদ খান। নাট্যমঞ্চ সম্পাদক জাহেদুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক সম্মাননা–স্মারক প্রদান করা হয় নাট্যকার ও নির্দেশক শিশির দত্ত এবং অভিনেতা ও নির্দেশক অলক ঘোষ পিন্টুকে। সম্মাননা পাওয়া শিশির দত্ত সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন নাট্যশিল্পী অধ্যাপক সনজীব বড়ুয়া ও অলক ঘোষ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন নাট্যজন সুশান্ত মিত্র। নাজমা আলি নিপার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে চৌধুরী জহুরুল হকের কবিতা আবৃত্তি করেন রাবেয়া জামান এঞ্জেলা।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, চৌধুরী জহুরুল হকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও ছিল অনুকরণীয়। চিন্তা–ভাবনার দিক থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন। তার নামের মধ্যে ছিল সে ব্যতিক্রমের ছোঁয়া। সাধারণত মানুষের নামের শেষে চৌধুরী থাকে। আমার মনে হয় ওনার মা–বাবা নাম রেখেছেন জহুরুল হক চৌধুরী। হয়তো তিনি চৌধুরী আগে নিয়ে এসেছেন। এখান থেকেই বুঝা যায় তার জীবনধারা ব্যতিক্রম ছিল।
তিনি বলেন, চৌধুরী জহুরুল হক একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। নাটকে যেমন তার ধার আছে তেমনি গানেও। সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে তিনি অনন্য সাধারণ। কথাহিত্যিক হিসেবে চৌধুরী জহুরুল হকের কৃতিত্ব রয়েছে। তিনি ছিলেন গল্পকার ঔপন্যাসিক। একাধারে তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, গল্পকার, গীতিকার, রসসাহিত্য স্রষ্টা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সৃজনশীল চিন্তা, গবেষণা ও সম্পাদনার কাজও করেছেন প্রচুর। কৈশোরেই তার মধ্যে সাহিত্যচেতনার উন্মেষ ঘটে। বারো বছর বয়সে ‘সচিত্র সন্ধানী’তে প্রকাশিত হয় তার রচিত গল্প ‘একটি কবিতার জন্ম’। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজে বাংলা সম্মান শ্রেণিতে পড়ার সময় পুরোপুরি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
এম এ মালেক বলেন, শিক্ষক হিসেবে নিবেদিতপ্রাণ জহুরুল হক সাহিত্যের প্রতিও ছিলেন প্রবল অনুরাগী। তাই শিক্ষকতা ও সাহিত্যচর্চা দুটোই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন। সাহিত্যে তার অন্যতম ব্যতিক্রমী সৃষ্টি রম্যরচনা ‘চোঙ্গা গল্প’।
তিনি বলেন, নাট্য জগতেও চৌধুরী জহুরুল হকের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ‘বাংলাদেশের নাটক: বিষয়বস্তু ও শিল্পরূপ’ নিয়ে গবেষণা করেন। বেতার, টেলিভিশন ও মঞ্চের জন্য তিনি প্রচুর নাটক রচনা করেন।
এম এ মালেক বলেন, মাহবুবুল আলম চৌধুরী রচিত ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শীর্ষক একুশের প্রথম কবিতার পূর্ণাঙ্গ মূল পাঠ উদ্ধারের কৃতিত্ব চৌধুরী জহুরুল হকের। এসময় একুশের প্রথম কবিতা কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপানোর ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, একুশ আমার অহংকার, একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ আমাকে শিখিয়েছে মাথা নত না করার। সে সাহসটা আমি পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। এ কবিতা ওই সময়ে (১৯৫২ সাল) ছাপানো মানে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের চোখে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কিন্তু মাতৃভাষা নিয়ে বাবা কোনো সমঝোতা করেননি, মাথা নত করেননি। বাবা জানতেন মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে হবে। তাই কবিতাটি ছাপিয়েছেন। মানে বাবা মাথা নত করেননি। অবশ্য এ কবিতাটি ছাপানোর কারণে আমাদের ম্যানেজার দবির উদ্দিন চৌধুরীকে আটক করা হয় এবং তার জেল হয়। ছয় মাস জেল কাটার পর যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে মুক্ত হন তিনি।
শেক্সপিয়রকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, পৃথিবীটাই একটা নাট্যমঞ্চ। আমরা যে যার মতো অভিনয় করে চলেছি। আর নাট্যভিনেতারা আমাদের বাস্তব জীবনের সেই অভিনয় মঞ্চে ফুটিয়ে তুলছেন।
‘আবৃত্তিশিল্পের লোকপ্রিয়তা ও নব্যকালের কবিতার কথা’ শিরোনামে নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক স্মারকবক্তৃতায় কবি হাফিজ রশিদ খান বলেন, বিশ্বভুবনে সব হারিয়ে আবার সব কুড়িয়ে পাওয়া পরমানন্দ অনুভূতি বা অমরাবতীর নাম কবিতা। এ পথেই অগ্রসরমান এই নতুন কবিতা ভরসা হয়ে থাকবে আরও দূরতর সুনন্দ পৃথিবীর আশায়– আরও–আরও নব নব বদল ও আলোড়নে বেঁচে থাকা জিজীবিষু মানুষের মনোপটে। তাই কালে–কালে নতুন কবিতার আবৃত্তিযোগ্যতাও নির্মিত হবে নতুন–নতুন নিরীক্ষায়, নতুন মনোযোগের প্রেক্ষাপটে, নতুন সহবতে– যখন নতুনত্ব সন্ধানী তরুণ আবৃত্তিশিল্পীরা এদিকে ঝুঁকবেন একক মননে অথবা তাদের যৌথ মনীষায়।
শিশির দত্ত বলেন, চট্টগ্রামের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আমাদের সৃষ্টি। আমরা হুঁট করে কোনো জায়গা থেকে ওঠে এসে কাজ করিনি। তিনি বলেন, সারা দেশ থেকে মাত্র তিনটি নাটকের কাগজ বের হয়। এর একটি নাট্যমঞ্চ। নাট্যমঞ্চের ১০টি সংখ্যা বেরিয়েছে। বর্তমান সময়ে এটি বিরল ঘটনা। এর নেপথ্যে আজকের প্রধান অতিথির (এম এ মালেক) বিশেষ ভূমিকা আছে।
অলক ঘোষ পিন্টু বলেন, বহুমাত্রিক লেখক ছিলেন চৌধুরী জহুরল হক। তিনি বলেন, আগে গ্রামে–গঞ্জে, স্কুল–কলেজে নাটক হত। এখন কেন জানি হয় না। নাটকের হাহাকার চলছে। ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়ে নানা জায়গায় চাকরি করেছেন। তাহলে ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে লাভ কি।
জাহেদুল আলম বলেন, নাট্যমঞ্চ এর ১০টি সংখ্যা বের হয়েছে, চট্টগ্রাম থেকে নাটক নিয়ে প্রকাশিত এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা। চট্টগ্রামকে প্রাধান্য দেয়া হয় নাট্যমঞ্চে। কারণ আঞ্চলিকতাকে বাদ দিয়ে জাতীয়তা কখনো হয় না। তিনি বলেন, অবাধ নাট্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাম্য ও সুন্দরের সম্মিলনে দেশ, সমাজ ও জাতি এগিয়ে যাক।
সনজীব বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার অগ্র প্রতীকদের একজন শিশির দত্ত। নাটকের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং নাটকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখছে শিশির দত্ত প্রতিষ্ঠিত বিটা। সুশান্ত মিত্র বলেন, অলক ঘোষ নির্লোভ, প্রচারভিমুখ ও নির্মোহ একজন মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন নাটক থাকবে।