জাতিসংঘ ১৯৮৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে প্রথম দিবসটি পালন করা শুরু করে। নারী দিবস পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করে নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু নারীর অধিকার এবং নারীর যথাযথ সন্মান আমরা দিতে পারছিনা। অধিকারের কথা দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে দেশে সরকার প্রধান নারী, বিরোধী দলের নেত্রী নারী সেদেশে নারীরা শিক্ষাদীক্ষায়, কর্মক্ষেত্রসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে আপন যোগ্যতায় এগিয়ে যাওয়ার সত্ত্বেও নারীরা পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার। এর জন্য দায়ী আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হীন মনমানসিকতা। পরিবারে একজন নারী ভোর হতে নিশীথ রাত অবধি যে পরিমাণ শ্রম দেয় তা একজন পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। নারীর এ শ্রমের কোনো মূল্যায়নও নেই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে। পরিবারে যে গৃহিণী পরিবারের সদস্যের ভালো খাবারের ব্যবস্থা, ভালো রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত দিনশেষে তার ভালোর চিন্তা কেউ করেনা। এমনকি পরিবারে নারীদের সাথে সুন্দর করে কথা বললে বা তার কাজের প্রশংসা করলেও স্ত্রীদের মনটা খুশীতে ভরে যায়। সুন্দর ব্যবহার করতে টাকার প্রয়োজন হয় না, এক্ষেত্রে ও পুরুষরা মনে করে সুন্দর কথা বললে বা স্ত্রীকে গৃহের কাজে সহযোগিতা করলে বৌ মাথায় চড়ে বসবে। আর কর্মজীবী নারী হলেতো কথাই নেই, তার ঘরে বাহিরে দ্বিগুণ খাটুনী। তথাপি স্বামী বা পরিবারের সদস্যদের কর্মজীবী নারীর প্রতি দায়িত্বে শৈথিল্য দেখা যায়। তারা ভাবে না যে চাকুরীজীবী মহিলাদেরও চাওয়া পাওয়া আছে সখ আহ্লাদ আছে। বিশেষ দিনে স্ত্রী স্বামীর কাছে স্পেশাল কিছু আশা করে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি, স্বামী ভাবে আমার স্ত্রীর তো আয় আছে আমার কোনো দায় নেই। ডাক্তারের চেম্বার হোক বা ঈদের কেনাকাটায় হোক স্বামীর মানিব্যাগ খুলতে অনীহা, এমনকি বাচ্চার লেখাপড়ার খরচ সেখানেও ভাগাভাগি, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে রূঢ় বাস্তবতা। এবার আসা যাক কর্মস্থলে, সেখানেও শিক্ষিত নারীরা প্রচণ্ড রকমের বৈষম্যের শিকার, আর বস পুরুষ হলেতো কথা নেই, কী করে নারী সহকর্মীকে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলবে, হেনস্তা করবে, কাজে বেশী খাটাবে, টাকা পয়সা কম দিয়ে নিজের পকেট ভারী করবে যেটা পুরুষ সহকর্মীর সাথে করেনা। আর পুরুষ সহকর্মীরা বসের কুকর্মের সহযোগী হয় ভুক্তভোগী নারীর প্রতি সহমর্মিতা বা সাহায্যের হাত বাড়ায় না। অশিক্ষিত নারী শ্রমিক পুরুষ শ্রমিক থেকে কম মজুরী পায়। অশিক্ষিত পুরুষরা অর্থের লোভে একাধিক বিয়ে করে সংসার নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে পায়ের উপর পা তুলে খায়। প্রতিবাদ করলে নারীকে চরম মূল্য দিতে হয়। দেহ ব্যবসাসহ ঘৃণ্য কাজে নারীদের বাধ্য করা হয়, নারী পাচার করা হয়। আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে নারীকে অস্থাবর সম্পত্তি এবং ভোগ বিলাসের সামগ্রী মনে করে সহিংসতা চালানো হতো। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বিশ্বব্যাপী নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে মেয়ে শিশুদের জীবন্ত কবর দেয়া, নারীদের দ্রুতগামী ঘোড়ার লেজের সাথে বেঁধে যেভাবে ক্ষতবিক্ষত করে পুরুষরা আনন্দ উপভোগ করতো তা মহানবী রহিত করেন। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। পবিত্র কোরআনে নারী -পুরুষদের বলা হয়েছে, ‘তারা তোমাদের ভূষণ, আর তোমরাও তাদের ভূষণ। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৭) মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম (তিরমিজি শরীফ)। মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত ঘোষণা করে ইসলাম নারী জাতিকে সর্বোত্তম সন্মানে ভূষিত করেছে, যে মর্যাদা পুরুষকে দেয়া হয়নি। মহানবী বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেছেন, ‘হে পুরুষগণ স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেরূপ অধিকার আছে, স্ত্রীদেরও তোমাদের প্রতি সেরূপ অধিকার আছে। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছো এবং তারই আদেশ মতো তাদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছো, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে। কিন্তু ইসলামের নির্দেশনানুসারে বেশীরভাগ পুরুষ নারীদের প্রতি সদয় আচরণ করেনা, সহিংস্র আচরণ করে। প্রতিদিনই নারী নির্যাতন সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। নারী নির্যাতন বন্ধে আইন আছে কিন্তু এর ব্যাপক প্রয়োগ নেই, অনেক সময় ভুক্তভোগী নারী সমাজে আত্নসম্মানের ভয়ে বা প্রাণের ভয়ে আইনের আশ্রয় নেয়া থেকে বিরত থাকে। সমাজে নারীর অবদান তুলে ধরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। বাস্তবে নারীর মর্যাদা যেমন নেই, কর্মের স্বীকৃতিও নেই। এ অবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করতে হবে। বর্তমানে নারীরা আর অনগ্রসর নয়, মহিলা কোটা ছাড়াই নারীরা আপন যোগ্যতায় মেধায় পুরুষদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। নারী সৈনিক, নারী বৈমানিক থেকে শুরু করে সকল চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারী যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। তবে নারীর অধিকার ও সম্মানের জায়গাটা এখনো নড়বড়ে। এর জন্য সরকার বা রাষ্ট্রকে আরও ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে হবে। চাকুরী বিধিতে আছে নারী সহকর্মীর সাথে আচরণ বিধিমালা কিন্তু বাস্তবে এর চর্চা নেই। পরিশেষে বলতে চাই,
‘নারীর প্রতি বৈষম্যের হোক নিরসন নারীর ক্ষমতায়নে হবে উন্নয়ন’ এই বিশ্বাসকে অন্তরে ধারণ করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একযোগে কাজ করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে নারীর জন্য বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ। আসুন, ‘মানবতা ফেরী করি মানবতায় জীবন গড়ি’।
লেখক : প্রাবন্ধিক; উপাধ্যক্ষ-বিএড কলেজ, চট্টগ্রাম