নিজেকে ভালো রাখার ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে তুলতে হবে

এমিলি মজুমদার | মঙ্গলবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সকালে ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ আর হাঁটতে যাওয়া হবে না। অথচ মাঝে মাঝে আমি নিজেই চাই ‘একটু বৃষ্টি হলে ভালো হতো, হাঁটতে যাওয়া লাগতো না’। কিন্তু পরক্ষণেই রেডি হয়ে বের হয়ে পড়ি। কিসের এ আকর্ষণ?

সকালে বাইরের পরিবেশটাই এমন থাকে যে, মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। সকাল থাকে কোলাহলমুক্ত; গাড়িঘোড়া কম থাকে বলে ধুলো কম ওড়ে। পরিচিত, অপরিচিত অনেকেই হাঁটছেন। একদিন যদি কাউকে না দেখি, তার সাথীদের জিজ্ঞাসা করি ‘উনাকে দেখছি না যে!’ আসলে সকালে হাঁটতে গিয়ে বিনি সুতার মালার মত একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় আমাদের, সব্জি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা সবাই এই একই বন্ধনে আবদ্ধ আমাদের সাথে। এই সম্পর্কে কোনও কুটিলতা নেই, নেই কোনও জটিলতা।

আমরা সবাই জানি রোগশোক, দুঃখকষ্ট আমাদের নিত্য সঙ্গী, সংসার একটা যুদ্ধক্ষেত্র। ভিন্ন ভিন্ন সংসারে সমস্যার ধরনও আলাদা। সকালের হাঁটাটা আসলে আমাদের সারাদিনের অক্সিজেন যোগায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাধারণত সবাই একটু দেরী করে বিছানা ছাড়ে, আয়েশ করে একটু লম্বা ঘুম দেয়। ভোরে হাঁটি বলে প্রতিদিন সকালেই উঠি, তবে ছুটির দিনগুলোতে আরো একটু বেশি ভোরে উঠে যাই। কারণ সেই দিনগুলোতে আমরা কাছাকাছি কোন মেঠোপথে, কখনো সমুদ্র সৈকতে, নয়তো কোন পাহাড়ে, বা সোজা কোনও রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে চলে যাই। কাছে দূরে যেখানেই যাই না কেন বাড়ি ফিরতে হয় সময়ে, কারণ মহিলা বলে সাংসারিক কাজ থেকেতো আমাদের ছুটি নেই, বাড়ি ফিরলে তবেইতো হবে সবার সকালের জলখাবারের ব্যবস্থা! আসলে আমাদের দেশের মেয়েরা সবাইকে সেবা দিতে দিতে নিজের জন্য একটু সময় বের করে নিতে পারে না কোনওভাবেই।

দিন বদলেছে, এখন মানুষ অনেক বেশি সচেতন। সকাল বেলা হাঁটার লোকসংখ্যা অনেক বেড়েছে, নিজেরাই তৈরী করে নিচ্ছে এক একটা গ্রুপ। এরা একসাথে হাঁটছে, ব্যায়াম করছে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনে দল বেঁধে চায়ের দোকানে আড্ডার ঝড় তুলছে, কখনোবা দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, সমাজসেবায়ও অংশ নিচ্ছে কোন গ্রুপ। একঘেয়ে জীবনে প্রাণের ছোঁয়া এনে দিচ্ছে সকালে হাঁটা। তবে আমার আহ্বান গৃহিণীদের প্রতি, যারা কোনওভাবেই নিজের জন্য একটু সময় বের করতে পারেন না। সকালে যেসব মহিলা হাঁটেন তাদের জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে বেশিরভাগ ডায়বেটিসের কারণে ডাক্তারের পরামর্শে হাঁটতে বের হন। জানি ডাইবেটিস হলে হাঁটাটা মাস্ট, কিন্তু ডায়বেটিস দরজায় নক করার আগে থেকে হাঁটলে অনেকেই এ রোগ থেকে রেহাই পেতো বলে আমার বিশ্বাস।

বিশেষ করে মহিলাদের সারাদিন মেশিনের মত চলতে হলেও শহুরে মহিলাদের কায়িক শ্রম কম। সকালের জলখাবার, স্কুলের টিফিন, দুপুরের খাবার, বিকেলের টিফিন, রাতের খাবার ছাড়াও সবার সার্বিক সাচ্ছন্দ্য এনশিওর করার দায়িত্ব তার! কিন্তু এই মানুষটাকে ভালো রাখার দায় কিন্ত পরিবারের অন্য সদস্যদের নেই। কাজেই নিজেকে কর্মক্ষম রাখতে হলে প্রতিটা মহিলার নিজের জন্য কিছুটা সময় বের করে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।

জানবেন, ইচ্ছে থাকলে উপায় একটা বের হবেই, সেই ইচ্ছেটাকেই জাগিয়ে তুলুন। চারদেয়ালে ঘেরা ঘর থেকে একটু সময়ের জন্য বের হয়ে দেখুন জীবনটা কত সুন্দর, আমাদের চারপাশ কত সুন্দর, অসুস্থ মানসিকতার মানুষের ভিড়ে সুস্থ মানসিকতার মানুষও অনেক আছে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনুভব করতে পারি বিভিন্ন ঋতুর আগমনী বার্তা। গাছ, ফল, আকাশ, বাতাস, পাখি মাধ্যমেও জানতে পারি এবং প্রাণ ভরে উপভোগ করি তা। কোন গাছে কখন মুকুল আসছে, কখন মুকুল ফলে পরিণত হচ্ছে, কখন পাকছে ….। ভোরের শিশির, শিউলি ঝরা সকাল আমাদের শারদীয় বার্তা বহন করে আনে, ফাল্গুনে বাগানগুলো রঙ বেরঙের ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়, পলাশ ভর্তি গাছ আমাদের মনে করিয়ে দেয় একুশে ফেব্রুয়ারির কথা। কৃষ্ণচূড়ার আগুন লাল রঙ আমাদের মনকে রাঙিয়ে তোলে। কদম ফুল সাথে করে বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে আসে, আমাদের মন তখন আনন্দে ভরে উঠে। মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে ভিজে ভেজা কাক হয়ে বাড়িতে ফেরা জন উপভোগ করে বলতো এ বয়সে!

টিয়া পাখিগুলো কামরাঙা গাছে বসে, ঠুকরে ঠুকরে সব কামরাঙা বিছিয়ে রাখে গাছের নীচে মাটিতে। ওপরে গাছের দিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যাবে পাতার রঙের সাথে মিশে থাকা সবুজ টিয়া পাখি। দূর থেকে কামিনি ফুলের সুবাস আমাদের কাছে এলে ছুটে যাই সেই দিকে। প্রাণ ভরে গ্রহণ করি সেই সুবাস। বকুল তলা দিয়ে যাবার সময় হয়তো একজন গেয়ে ওঠে বকুল বিছানো পথে’

হঠাৎ কোন নতুন গাছ দেখতে পেলে, পরিচিত হই নতুন গাছের সাথে, ফুলের সাথে।

একদিকে ফুল ফল ভরা গাছ দেখলে মন যেমন দুলে ওঠে, সেই মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয় যখন দেখি নির্দয়ভাবে গাছগুলোকে কেটে ফেলা হচ্ছে! কোনওদিন হয়তো জবা ফুলে ভরা সজীব গাছটাকে এমনভাবে কাটা হলো, দেখলে মনে হবে অনেক আক্রোশ ছিল গাছটার ওপর। নয়তো কৃষ্ণচূড়া গাছটা গোড়া থেকে কাটা হয়েছে, পলাশ ফুলের ডাল বলতে আর নেই। বুঝতে পারি না এর কারণ বা মানসিকতা।

কিছুদিন আগে দেখি পাঁচছয়জন বস্তির ছেলে চালাচ্ছিল ‘অপারেশন আম চুরি’, আমরা বাধা দেইনি। মন ভরে উপভোগ করছিলাম ওদের আম চুরি, আর ফিরে যাচ্ছিলাম আমাদের ছোটবেলায়। মাঝেমাঝে হয়তো টুক্‌ করে একটা আম আমাদের সামনে ঝরে পড়ে, তখন চট্‌ করে অন্য কেউ নেবার আগে আমটা তুলে নেয়া ….এই ছোটছোট আনন্দগুলোই আমাদের প্রাতঃভ্রমণের আকর্ষণ।

আম, জাম, কলা, কাঁঠাল, খেজুর, পেয়ারা, জামরুল, কামরাঙা, আমলকি, তেতুল, নারকেল, ডেউয়া(বত্তা), গাব, তালসুপারী হরেক রকমের ফল গাছ, আরো আছে হরিতকি, অশোক, নিম, পাইন, ইউক্যালিপটাস, গোলপাতা, মেহ্‌গনি, জারুল, শিলকড়ি, অর্জুন, তেজপাতা ….কী গাছ নেই আমাদের মহল্লায়। ফুলের নাম নিয়ে শেষ করা যাবে না ….সকালে হাঁটতে না বের হলে জানাই হতো না আমাদের এই সোসাইটিতে রয়েছে এতো গাছের সমারোহ। অনেকে ছাদে বাগান করেছে, ফুল আর ফলের ভারে ভেঙে পড়ছে গাছগুলো। সকালে হাঁটতে বের হই বলেই গাছগুলোর সাথে আমাদের সখ্যতা গড়ে উঠেছে।

আমি ইচ্ছে করেই একটু ডিটেইলে লিখলাম এই বুঝাতে যে, সকালে অতটুকু হাঁটার সময় আমরা ভুলে যাই আমাদের সংসারের সমস্ত ঝক্কিঝামেলা, টেনশন, ঝগড়াবিবাদ, মানঅভিমান। প্রতিটা সংসারেই কোনও না কোনও সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে মেয়েরা যারা নিজেকে ইচ্ছেতে হোক বা অনিচ্ছাতে চারদেয়ালে বন্দী করে রেখেছে!

সবার প্রতি আমাদের উদাত্ত আহ্বান ….. সকাল একটু হাঁটার অভ্যাস করুন, অনেক ভালো থাকবেন। কমবেশি নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের জীবন। মানসিক প্রশান্তি এনে দেবে এই প্রাতঃভ্রমণ, মন ও শরীর দুটোই ভালো থাকবে। প্রকৃতির কাছাকাছি গেলে প্রকৃতি প্রেম বাড়বে, মানুষের সংস্পর্শে আসলে নিজের সমস্যাকে তুচ্ছ মনে হবে, যা এখন আমাদের পরিবেশ রক্ষায় একান্ত প্রয়োজন। আসুন ….সাময়িক অলসতা ত্যাগ করে, সবাই সকালে হাঁটি, সুস্থ থাকি মানসিক এবং শারীরিক দুদিক থেকেই। লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদীর হাওয়া
পরবর্তী নিবন্ধস্বপ্নে সংযোগের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ