পর পর দুটি অনুদান নির্ভর বাজেট ঘোষণার পর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে নিজস্ব উৎসের আয়কে প্রাধান্য দিলেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তবে আয়বর্ধক প্রকল্প প্রাধান্য না পাওয়ায় নিজস্ব উৎসের এ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গেলে পৌরকরের ‘চাপ’ বাড়বে নগরবাসীর উপর। কারণ নিজস্ব উৎসে ৯টি খাত থাকলেও সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ আয় ধরা হয়েছে পৌরকর থেকে। যা বাজেটের মোট আয়ের ২৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গতকাল বুধবার ঘোষিত চসিকের ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে। বাজেটে গৃহকরের চাপের মধ্যেও নগর উন্নয়নে আনুমানিক ৬ হাজার ২০১ কোটি টাকার ১০টি প্রকল্প পাইপলাইনে থাকার সুসংবাদ দেন মেয়র।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন রেজাউল করিম চৌধুরী। ২০২১ সালের ২৭ জুন তিনি নিজ মেয়াদের প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন। ২০২১–২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত ওই বাজেট ছিল অনুদান নির্ভর। এতে সর্বোচ্চ ৬৪ শতাংশ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে অনুদান ও ত্রাণ সাহায্য খাতে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা উন্নয়ন অনুদান এবং চার কোটি টাকা ত্রাণ সাহায্য খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে।
২০২২ সালের ২৬ জুন নিজ মেয়াদের দ্বিতীয় বাজেট ঘোষণা করেন মেয়র। ২০২২–২০২৩ অর্থবছরের ওই বাজেটও ছিল অনুদান নির্ভর। এতে সর্বোচ্চ ৫৬ দশমিক ৩০ শতাংশ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় অনুদান ও ত্রাণ সাহায্য খাতে। এর মধ্যে এক হাজার ২১২ কোটি টাকা উন্নয়ন অনুদান এবং পাঁচ কোটি টাকা ত্রাণ সাহায্য খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।
পরপর দুটি বাজেট অনুদান নির্ভর হওয়ায় নির্বাচনী ইশতেহার ও সভা–সমাবেশ এমনকি বাজেট বক্তব্যেও সিটি কর্পোরেশনকে স্বাবলম্বী করার যে কথা বলেন তার প্রতিফলন না ঘটায় ‘হতাশ’ হন নগরবাসী। সর্বশেষ তৃতীয় বাজেটে অনুদান নির্ভরতা থেকে বেরুলেও তার চাপ পড়ার শঙ্কা রয়েছে নগরবাসীর উপর।
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার (২০২৩–২০২৪) বাজেটে এবারের নিজস্ব উৎস থেকে ৯৫০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা আয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে পৌরকর (হোল্ডিং ট্যাঙ, আলোকায়ন ও পরিচ্ছন্ন রেইট) ধরা হয়েছে ৪৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত পৌরকরের মধ্যে হাল গৃহকর, আলোকায়ন ও পরিচ্ছন্ন রেইট খাতে ২২২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এবং বকেয়া গৃহকর, আলোকায়ন ও পরিচ্ছন্ন রেইট খাতে ২২৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ২০২২–২০২৩ অর্থ বছরে পৌরকর খাতে চসিকের আয় হয় ১৯৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
গৃহকর বিষয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, করদাতাদের নানাবিধ ও অর্থনৈতিক সমস্যা বিবেচনায় ধার্যকৃত মূল্যায়নের উপর আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য ছয়টি রিভিউ বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ডে আমি নিজে উপস্থিত হয়ে গণশুনানির মাধ্যমে করদাতাদের চাহিদামত সহনীয় পর্যায়ে কর মূল্যায়ন করায় করদাতারা আগ্রহ নিয়ে শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। তারা নিয়মিত পৌর কর পরিশোধ করছেন। এতে নগরবাসীর গৃহকর নিয়ে যে অসন্তোষ ছিল তা প্রশমিত হয়েছে।
এদিকে ২০২৩–২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নগর উন্নয়নে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখলেও তার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে মন্ত্রণালয়ের উপর। কারণ ৮টি প্রকল্পের বিপরীতে উন্নয়ন অনুদান হিসেবে ৮৯৪ কোটি কোটি আয় ধরা হয়। ২০২২–২০২৩ অর্থ বছরে প্রকল্পগুলোর বিপরীতে ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বরাদ্দ মিলে ৬৪১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অনুদান মিলেনি। এর আগে ২০২১–২০২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার উন্নয়ন অনুদানের প্রস্তাব করলেও বরাদ্দ মিলে ৬৮৯ কোটি টাকা। ফলে অর্থবছর দুটিতে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল কম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার বাজেটের আকার কমানো হয়। যদিও মেয়র দাবি করেন, ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে আকার কমানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২–২০২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকারও পূর্বের অর্থাৎ ২০২১–২০২২ অর্থবছরের চেয়ে ৩০২ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা কম ছিল। সেবার আকারের চেয়েও বাস্তবায়নে জোর দেয়ার কথা বলেন মেয়র। যদিও এ বাজেট বাস্তবায়নের হার হচ্ছে ৫৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।
এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে আয়বর্ধক প্রকল্প নিয়ে স্পষ্ট তথ্য না থাকলেও মেয়র দাবি করেন চসিকের আয় বাড়াতে বিভিন্ন আয়বর্ধক প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। এসময় তিনি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উন্নয়ন চার্জ আদায়ে জোর দেন। বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উন্নয়ন চার্জ আদায় করতে পারলে কারো দিকে তাকাতে হবে না। নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণ ও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি–রপ্তানির ওপর কর আরোপের অনুমতি সংক্রান্ত নীতিমালা অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দিয়েছি।
মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে সিটি কর্পোরেশন কর বা ফি আদায় করবে। তখন আর সরকারি বরাদ্দের উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে না। তিনি বলেন, নিজস্ব আয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। সরকার থেকে আগের মত তেমন ‘থোক বরাদ্দ’ দেয়া হয় না। প্রকল্পের অধীনে বরাদ্দ পাই শুধু।
পাইপলাইনে ১০ প্রকল্প : পাইপলাইনে নগর ভবন নির্মাণসহ ১০টি প্রকল্প রয়েছে বলে জানান মেয়র। প্রকল্পগুলো হচ্ছে– ২০২৩ কোটি টাকায় নগর ভবন নির্মাণ; ২৯৮ কোটি টাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে আধুনিক যান যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্প; ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উন্মুক্ত স্থানসমূহ আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও সবুজায়ন প্রকল্প; ১ হাজার ১০০ কোটি টাকায় ৭টি রাস্তার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প; ২৫০ কোটি টাকায় কিচেন মার্কেট কাম বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প; ২ হাজার কোটি টাকায় ওশান অ্যামিউজমেন্ট পার্ক নির্মাণ প্রকল্প; ৪৫০ কোটি টাকায় ওয়ার্ড কার্যালয় নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন; ৭০০ কোটি টাকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রেল ক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্প। এছাড়া টাইগার পাস হিলে চট্টগ্রাম ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ এবং আন্তঃজেলা বাস–ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে।