সম্প্রতি ২৯–৩১ ডিসেম্বর ২০২২, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে অনুষ্টিত হলো চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক ‘২য় আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন’। দেশ–বিদেশের খ্যাতিমান চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণে শিশুস্বাস্থ্য, মেডিসিন, সার্জারি, প্রসূতিবিদ্যা, ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধুনা প্রায় সকল শাখা–স্পেশালিটি নিয়ে সেমিনার–সিম্পোজিয়ামে উপস্থাপিত হয়েছে নানা গবেষণাপত্র।
অনেকের মতো গর্ব অনুভব করি ডা. শাহ্ আলম বীরোত্তম, স্যারকে শিক্ষক–রুপে পেয়েছিলাম বলে। তাঁরই স্মরণ নামাংকিত অডিটোরিয়াম ও চমেক নিউ একাডেমিক বিল্ডিং–এ আয়োজিত গৌরবোজ্জ্বল অধিবেশনে স্পষ্ট হয়েছে মানবকল্যণে কার্যকর প্রণালী, নানা স্বাস্থ্য–তথ্য বার্তা।
‘এলকেপটোনুরিয়া’ একটা ‘কেইস রিপোর্ট ’–
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শিশু–স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আমার মেধাবী ছাত্রী শাম্মী আক্তার ও বিভাগের কৃতী শিক্ষকবৃন্দ –মোহাম্মদ মারুফ–উল কাদের, এ.কে.এম রেজাউল করিম, উৎপল সেন ‘পোস্টার প্রেজেন্টেশানে’ উপস্থাপন করেন এক দুরুহ ‘কেইস রিপোর্ট’।
মাস্টার আহমদ এর বয়স মাত্র ১৪ মাস। বাড়ি বাঁশখালি। বিয়ের আগে তার মা–বাবা নিকটাত্মীয় ছিলেন। জন্মকাল থেকে আহমদ এর প্রসাবের কাপড়ে দাগ পড়ার ইতিহাস। তার মূত্র যখন জারে করে সংগ্রহপূর্বক রেখে দেওয়া হলো, তখন বাতাসের সংস্পর্শে তা প্রথমে বাদামী ও পরে কালো রঙ ধারণ করে।
শিশুর রোগ নির্নয় নিশ্চিত করা হয়– ‘এলকেপটোনুরিয়া’। এটা কোনো সচরাচর অসুখ নই। প্রতি ২৫০০০০ জন্মে একজন শিশুতে এই রোগ মেলে, তবে স্লোভাকিয়াতে প্রতি ১৯০০০ শিশু জন্মে ১ জন নবজাতক এ রোগ নিয়ে ভূমিষ্ট হয়। নিকটাত্মীতের মধ্যে বিয়েতে যখন মা–বাবা উভয়ে যখন এ রোগের বাহক থাকেন,তখন দ’ুজন থেকে প্রাপ্ত ‘ডাবল ডোজ অসুস্থ জিন’ মিলে সন্তানের মধ্যে এ ধরনের বংশগত রোগ উৎপন্ন করে।
এ রোগে হোমোজেনটিসিক এসিড দেহ কোষ, চোখ এবং দেহের বিভিন্ন জয়েন্টে, মাংসপেশিতন্ত্রে জমা পড়ে। চোখ দেখতে বিবর্ণ কালো দেখায়। গিঁটে, মেরুদন্ডে তীব্র ব্যথা। হাতের তালু, পায়ের পাতা নীলচে–কালো হয়ে যায়। বর্তমান চিকিৎসা বলতে কেবল ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার”। তবে যুক্ত হয়েছে দুষ্প্রাপ্য রোগ নিরাময়কারী ‘নির্দিষ্ট এনজাইম ঘাটতি পূরণ’, ও ‘নষ্ট জিন শোধন’ সাম্প্রতিকতম চিকিৎসা–ব্যবস্থাপনা।
নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে–
ক. বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের প্রচলন রয়েছে। সারা বিশ্বে ১০০ কোটির বেশি মানুষ এ রকম সংস্কৃতি ধারণ করে, যেখানে প্রতি তিনটি বিয়ের একটি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে হয়ে থাকে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, ইরান ও দক্ষিণ এশিয়ায় নিকটাত্মীয়ের মধ্যে এ ধরনের বিয়ে বেশি ঘটে। এসব বিয়ে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি হয়, তাতে বাল্যবিবাহের আধিক্যও বেশি।
প্রথম পর্যায়ের বা ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ মানে আপন চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে। আর দ্বিতীয় বা সেকেন্ড ডিগ্রি রিলেটিভ মানে বাবা বা মায়ের চাচাতো, মামাতো, খালাতো বা ফুফাতো ভাইবোনের সন্তানদের মধ্যে বিয়ে। এই দুই ধরনের কাজিন ম্যারেজের কারণে জন্ম নেওয়া সন্তানের মধ্যে নানা বংশগত রোগের ঝুঁকি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বিশেষত জিনবাহিত বংশধারার রোগগুলোর প্রকোপ এতে বাড়ে। অসুস্থ জিনগুলোর কার্বন কপি যখন মা–বাবা দুই বাহক থেকে সন্তানে বাহিত হয়, তখন তা তীব্র আকারে প্রকাশ পায়।
চাচাতো, মামাতো, খালাতো ও ফুফাতো ভাই–বোনদের মধ্যে বিয়ের পরিণামে যে সন্তান হয়, তার মধ্যে জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়ার ঝুঁকি বেশি। সন্তানের জিনগত অস্বাভাবিকতার হার সাধারণ শিশুদের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। এসব অস্বাভাবিকতার মধ্যে নবজাতকের অতিরিক্ত আঙুল গজানোর মতো সমস্যা থেকে শুরু করে হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র বা মস্তিষ্কের গঠন–প্রক্রিয়ায় ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
খ. আমাদের সমাজে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার সংস্কৃতিটা সেইভাবে প্রচলিত না বটে। তবে এটা মোটামুটি সচরাচর ঘটনা। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩০% থেকে ৫০% জনগোষ্ঠী কাজিন ম্যারেজ করে থাকে। কিন্তু সমপ্রতি ভারতের পাঞ্জাব ও হারিয়ানা হাইকোর্ট এই কাজিন ম্যারেজকে পুরোপুরি অবৈধ ঘোষণা করেছে। নর্থ ইন্ডিয়াতেও এটি অবৈধ বলে গণ্য। পাকিস্তানের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬০% থেকে ৬৬% মানুষ বিয়ে করে তাদের খুব নিকটাত্মীয়ের সাথে, যাদের সাথে রয়েছে রক্তের সম্পর্ক। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। সৌদি আরবে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০% মানুষ, ইরাকে ৩৩%, এবং আফগানিস্তানে ৩০–৪০% মানুষ বিয়ে করে তাদের ফার্স্ট কাজিন (আপন চাচাতো, খালাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাই–বোন) অথবা সেকেন্ড কাজিনকে (মা–বাবার কাজিনদের ছেলে–মেয়ে)। এছাড়াও আলজেরিয়া, বাহরাইন, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের সংস্কৃতি পৃথিবীর অন্য সব দেশগুলোকে হার মানায়।
পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কাজিন ম্যারেজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। চীন, তাইওয়ান, নর্থ কোরিয়া, সাউথ কোরিয়া, ফিলিপাইনসহ আরো বিভিন্ন দেশে রক্তের সম্পর্কের নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করা নিষেধ।
অসুস্থ সন্তান জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি–
নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে বিজ্ঞানসম্মত নয়। দ্য ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য জানিয়েছেন। ব্র্যাডফোর্ড শহরে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের মধ্যে ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী সাড়ে ১৩ হাজার শিশুকে এক গবেষণার আওতায় আনা হয়। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এয়ামন শেরিডান। সেখানে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩৭ শতাংশই রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে।
এই ধরনের বিয়ের ফলে জন্ম নেয়া অধিকাংশ নবজাতকদের মধ্যে ডায়াবেটিস মেলিটাস, ব্রেস্ট ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস, ভিটামিন ‘ডি’ ডেফিসিয়েন্সি, চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা ইত্যাদি আরো অনেক রোগ বেশি দেখা যায়।
বিজ্ঞান বলে, ফার্স্ট কাজিনদের মধ্যে অন্তত ১২% জিনগত মিল থাকে। ফলে এটার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যে, কাজিন ম্যারেজের ফলে জন্ম নেয়া শিশুরা বংশগত রোগগুলোতে বেশি আক্রান্ত হয়।
নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের কারণে সন্তানের যেসব ঝুঁকি বাড়ে তা হলো:
১. গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব
২. শারীরিক ত্রুটিসংবলিত শিশুর জন্ম স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি হয়
৩. প্রথম বছর বয়সে শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু
৪. হঠাৎ অজানা কারণে শিশুমৃত্যু
৫. যথাযথভাবে শিশু বৃদ্ধি না হওয়া
৬. শ্রবণশক্তি দৃষ্টিশক্তি বুদ্ধির প্রতিবন্ধিতা
৭. মৃগী রোগ
৮. অজানা রোগ
৯. নানা রকমের রক্তরোগ যেমন সিকেল সেল ডিজিজ ও বিটা থ্যালাসেমিয়া।
উপসংহার–
বাংলাদেশে এমনিতেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বেশি, হিমোগ্লোবিন–ই ডিজিজের বাহকও কম নয়। নিকটাত্মীয়ের বিয়েতে এ ধরনের রোগ নিয়ে সন্তান জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। যেসব পরিবারে জন্মগত বিভিন্ন রোগের ইতিহাস আছে, সেখানে নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা উচিত।
লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।