বিজ্ঞানের চাকা এগিয়ে চলছে তড়িৎ গতিতে। আমরা সকলেই জানি, চাকার আবিষ্কার না–হলে মানবসভ্যতা স্থবির হয়ে যেত। আজকের যে –আধুনিক বিশ্ব, দু’চোখ খুলে যা দেখছি, তাঁর নেপথ্যে কোনো না কোনোভাবেই চক্র–সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের গতিশীলতা যুক্ত। ইন্টারনেট ও কয়োন্টাম কম্পিউটার বিশ্বকে দিয়েছে আরো দ্বিগুণ গতি। এবার একটি উপন্যাসের সংলাপের দিকে নজর দেয়া যাক।
‘তুমি একজন বিশ্বাসঘাতক। তুমি একজন থট ক্রিমিনাল’। হাতে খেলনা পিস্তল ধরে চিৎকার করে বলছে এক খুদে। বলছে উইন্সটন স্মিথকে। স্মিথ এসেছেন তাঁর প্রতিবেশীর বাড়িতে। খুদেটি সেই প্রতিবেশীরই সন্তান। জর্জ অরওয়েল–এর ‘১৯৮৪’ উপন্যাসের একটি দৃশ্য এটি। উপন্যাসে খুদেটি শেষমেশ নিজেরই বাবাকেই ‘থট ক্রাইম’–এর অপরাধে তুলে দিয়েছিল পুলিশের হাতে। অরওয়েল এই উপন্যাসের মাধ্যমেই আমাদের প্রথম পরিচিয় হয় ‘থট ক্রাইম’, ’থট পুলিশ’, এই সব শব্দের সঙ্গে। জর্জ অরওয়েল দেখিয়েছিলেন যে, ‘বিগ ব্রাদার’–এর সাম্রাজ্যে যে কেনো স্বাধীন ভাবনাই এক অপরাধ। অরওয়েল তাঁর ডিসটোপিক উপন্যাসে যা লিখেছিলেন তা কি এবার সত্য হতে চলেছে? তেমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নীতা ফারহানি তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে। গ্রন্থটির নাম, ‘দ্য ব্যাটল ফর ইয়োর ব্রেন: ডিফেন্ডিং দ্য রাইট টু থিংক ফ্রিলি ইন দ্য এজ অফ নিউরোটেকনোলজি’।
নীতা ফারহানির আশঙ্কাটা খাটো করে দেখার কিন্তু কোনো কারণ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা কী পছন্দ করছি আর করছি না, তার হিসেবে নিকেশ করে ইতিমধ্যেই আমাদের মস্তিষ্কের নানা কার্যকলাপকে পড়ে ফেলা শুরু হয়ে গেছে। আমরা তো দেখছি ফেইসবুকে একটি বিজ্ঞাপন একবার দেখলেই ওই একই ধরণের একাধিক বিজ্ঞাপন ঘুরে ঘুরে টাইমলাইনে আসতে থাকে। সেদিন আর সত্যিই খুব বেশি দূরে নয় যখন মস্তিষ্কের সমস্ত কার্যকলাপকেই সরাসরি পড়ে ফেলতে পারবে নিউরোটেকনোলজি।
নিউরোটেকনোলজির মূল কথা হলো মানুষের মস্তিস্ক এবং একটি মেশিনের সঙ্গে সংযোগ সাধন। এর পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্রেন–কম্পিউটার ইন্টারফেস’ অথবা ‘ব্রেন–মেশিন ইন্টারফেস’। এই প্রযুক্তিতে একটি ডিভাইস বা যন্ত্র মানুষের মস্তিস্কে সরাসরি যুক্ত করে দেয় একটি কম্পিউটার, একটি মেশিন বা একটি স্মার্টফোনের সঙ্গে। ‘ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস’–এর ক্ষমতা রয়েছে মানুষের মস্তিষ্ক ও বহির্জগতের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার। কেমন এই সংযোগ স্থাপন? মস্তিষ্কে সঞ্চিত বিভিন্ন তথ্য যেমন এই ইন্টারফেস বহির্জগতে চালান করে দিতে পারে, তেমনই বগির্জগতের ক্ষমতাও রয়েছে মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করার। ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়েছে যে, নিউরোটেকনোলজি প্যারালাইসিস হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া মানুষকে মিনিটে আঠারোটি করে শব্দ উচ্চারণ করাতে সক্ষম।
ব্রেন–কম্পিউটার ইন্টারফেস দু–রকম ভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। একটি ইনভেসিভ এবং আর একটি নন–ইনভেসিভ। ইনভেসিভ পদ্ধতিতে মস্তিস্কে অপারেশন করে একটি চিপ প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নন–ইনভেসিভ পদ্ধতিতে অবশ্য তাঁর প্রয়োজন নেই। মাথায় কেনো একটি যন্ত্র পরিয়ে দিলেই ব্রেন–কম্পিউটার ইন্টারফেসের কাজ শুরু হয়ে যাবে।
নিউরোটেকনোলজির এই অভূতপূর্ব উন্নতি বিশেষ করে চিকিৎসাক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছে। ইনভেসিভ টেকনোলজির ব্যবহার মুক্তি দিতে পারে পারকিনসন রোগ থেকে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিকিৎসা করা সম্ভব হতে পারে ডিমেনশিয়া আর অ্যালঝাইমার্স রোগেরও। মৃগী রোগীদের চিকিৎসাও করা সম্ভব হতে পারে এই প্রযুক্তির ব্যবহারে। ব্রেন সেন্সর এবং অ্যার্টিফিয়াল ইন্টেলিজেন্স–এর ব্যবহারে চেতনা হারাবার ঠিক আগের মুহূর্তেই সতর্ক করে দেওয়া যেতে পারে এই সমস্ত রোগীদের। মানসিক অবসাদের চিকিৎসাও এই পদ্ধতিতে করা সম্ভব। ট্রমার শিকার যে সমস্ত মানুষ তাঁরাও সক্ষম হবেন যে–স্মৃতিগুলি ট্রমার কারণ সেই স্মৃতিগুলিকে মুছে ফেলতে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়, এই প্রযুক্তির ব্যবহার করে মস্তিষ্কের বিভিন্ন ভাবনাকে করায়ত্ত করার চেষ্টাও করা হয়েছে ইতিমধ্যেই। ২০১৮ সালে, এমআইটি মিডিয়া ল্যাব একটি ইনভেসিভ ব্রেন–কম্পিউটার ইন্টারফেস ব্যবহার করে মানব–মস্তিষ্কের ভাবনাকে কম্পিউটারে টাইপ করে ফেলতে পেরেছ। নন–ইনভেসিভ পদ্ধতি ব্যবহার করেও দু–টি পৃথক কক্ষে বসে–থাকা দুই ব্যাক্তির মধ্যে শব্দের আদান–প্রদান ঘটানো সম্ভব হয়েছে। একে অপরের মুখোমুখি না–থেকেই তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে পেরেছেন। ২০১৯ সালে ব্রেন–কম্পিউটার ইন্টারফেস পদ্ধতির ব্যবহারে ইঁদুরদের মস্তিষ্কের কতগুলি অংশকে বারবার উদ্দীপ্ত করে তাদের একই কাজের পুনরাবৃত্তি করাতেও সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানী। অদূর ভবিষ্যতে মানুষেরও দৈনন্দিন কার্যক্রম যে এইভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
প্রশ্ন হলো যে, মস্তিষ্কের কতটুকু পড়তে পারবে ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস? এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত লেখক নীতা ফারাহানি বলেছেন, ‘ওয়াইল দ্য টেকনোলজি ক্যানট লিটারারিলি রিড আওয়ার কম্পলেক্স থটস, দেয়ার আর অ্যাট লিস্ট সাম পাটস্ অব আওযার ব্রেন অ্যাকটিভিটি দ্যাট, ক্যান বি ডিকোডেড’। এবং এই সম্ভাবনাটিই কিন্তু যথেষ্ট বিপদজনক। এ কথা ঠিক যে, এখনও তো বিভিন্ন কোম্পানি ও ফ্যাক্টরিতে কর্মচারীদের নিয়মিত নানা ধরনের নজরদারিতে রাখা হয়। পরীক্ষা করা হয় তাঁদের ই–মেল, হার্ড ডিস্ক। তবে, ব্রেন–কম্পিউটার ইন্টারফেসের ফলে এবার থেকে মালিক পক্ষের হাতে একজন কর্মচারীর সেই সমস্ত তথ্যও চলে যাবে যা হয়তো ই–মেল বা কম্পিউটারে ধরা নেই। যেমন তাঁদের ক্লান্তি, মনসংযোগ, হতাশা এবং স্ট্রেস। নীতা ফারহানি আশংকা প্রকাশ করেছেন যে, স্বৈরাচারী সরকার এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারে যে কেনো ধরনের বিরোধী মতকে নিকেশ করতে। ভবিষ্যতে, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যুদ্ধাস্ত্রও তৈরি হতে পারে। সেই ‘মাইক্রোওয়েভ ওয়েপন’ শত্রু পক্ষের মস্তিষ্ক দখল করবে। মনে করার কিন্তু কারণ নেই যে, এ সবই সম্ভাবনা মাত্র। চীনে এই প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই নানা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে শুরু করেছে। এরকম অভিযোগও উঠেছে যে একটি ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের বিশেষ এক ধরনের টুপি ও হেলমেট পরতে বাধ্য করে তাদের মস্তিস্কের বিভিন্ন করে শ্রমিকদের আবেগের বিশ্লেষণ করা গেছে, বোঝা গেছে শ্রমিকদের আবেগ কীভাবে উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। চীনেই ২০১৯ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের মনঃসমযোগের পরিমাণ মাপার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল হেডসেট। তাঁদের সন্তানদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অন্য কেউ, অভিভাবকদের একাংশের এই আশঙ্কা এবং তীব্র প্রতিবাদের কারণেই শেষ পর্যন্ত এই পরীক্ষা অবশ্য বন্ধ করা হয়।
এই পদ্ধতিটিকে বন্ধ করা গেছে বলেই আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ এমনটা ভাববার কারণ নেই। ইতিমধ্যেই একাধিক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি প্রতি দিনের ব্যবহার্য বিভিন্ন ডিভাইস (সে ইয়ারবাড থেকে শুরু করে স্মার্ট ওয়াচ সবই হতে পারে), যেগুলিতে ব্রেন সেন্সর ব্যবহার করা যেতে পারে, তা প্রস্তুত করার জন্য বহু অর্থ বিনিয়োগ করেছে। সেদিন আর বেশি দূরে নয় যখন দৈনন্দিন কাজকর্মেই আমাদের এমন একাধিক ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে যেগুলিতে ব্রেন সেন্সর থাকবে। আতঙ্কের এটাই যে, এই ব্রেন সেন্সর সংযুক্ত ডিভাইসগুলো প্রস্তুত করবে কেনো বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানি। যে–সমস্ত তথ্য সংগৃহীত হবে তা চলে যাবে এই কোম্পানিগুলির দখলে। মস্তিষ্কের কেনো তথ্যই আর ব্যক্তিগত থাকবে না।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার ক্রমশ উন্মুক্ত করছে নিউরোটেকনোলজি, তাতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার রোধ অনুচিত। বরং এই প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণের কাজেই ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে এটাও সুনিশ্চিত করতে হবে যে, আমাদের মস্তিষ্কের অধিকার যেন আমাদের নিজেদের থাকে। সেজন্যই প্রয়োজন ‘নিউরো রাইটার্স’। ইতিমধ্যেই চিলি নিউরো রাইটার্স সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে নিয়েছে। সম্প্রতি নিউরো রাইটস ফাউন্ডেশন ‘ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইট প্রটেকশন গ্যাপস ইন দ্য এজ অফ নিউরোটেকনোলজি’ এই শিরোনামে একটি নথি প্রকাশ করেছে। নথিটিতে তারা নিউরোরাইটস নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের আর্জি জানিয়েছে জাতিসংঘের কাছে। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর একটি বক্তৃতায় (যা পরে ‘ফ্রি থট অ্যান্ড অফিসিয়াল প্রোপাগান্ডা’ শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়) বলেছিলেন যে, সেই ভাবনাই মুক্ত যার উপর বহির্জগতের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আজ সেই সম্ভাবনার দোরগোড়ায় আমরা দাঁড়িয়ে যখন আমাদের প্রতিটি ভাবনার ওপরই দখলদারি কায়েম করতে পারে বহুজাতিক সংস্থা এবং রাষ্ট্র। তাই এখন আর মৌন থাকলে তো চলে না।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।