নিঃস্ব ৩২ পরিবার

চকরিয়ায় বসতঘরে আগুন

চকরিয়া প্রতিনিধি | শনিবার , ৭ মে, ২০২২ at ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ

মসজিদে তখন ঈদের নামাজ চলছিল। একই সময়ে শুরু হয় দমকা হাওয়া। ঠিক সেই মুহূর্তে চুলা থেকে একটি বাড়িতে আগুন লাগে। সেই আগুন বাতাসের সাথে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। এতে মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী ঘনবসতিপূর্ণ পুরো পাড়ার ৩২টি বসতবাড়ি পুড়ে সম্পূর্ণ ছাই হয়ে যায়। সেই সাথে চুরমার হয়ে যায় পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

মুহূর্তের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় কারো মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য জমানো টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, আসবাবপত্র, কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে এসব বসতবাড়ির সমুদয় মালামাল। আগুনের লেলিহান শিখা এতই তীব্র ছিল যে একটি বাড়ি থেকে ঠুনকো জিনিসপত্রাদিও বের করা যায়নি। শুধুমাত্র পরনে থাকা এক কাপড়েই এসব পরিবারের সবাইকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। গত মঙ্গলবার ঈদের দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ধূপিপাড়া ও তৎসংলগ্ন মুসলিম পাড়ায়। তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তর কর্তৃক অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর নিরূপনকৃত অনুযায়ী ২ কোটি ৫ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে এই ক্ষতি অন্তত ৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো জানিয়েছে।

পরদিন বুধবার সরেজমিনে অগ্নিকাণ্ডস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সেইদিনের অগ্নিকাণ্ডের এতই ভয়াবহতা ছিল যে, পুরো পাড়াই এখন বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। সেখানে ছাই ছাড়া অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। অচেনা কোনো মানুষ দেখলেই তার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে অবলা শিশুরাও।

ক্ষতিগ্রস্ত ধূপিপাড়ার বাসিন্দা বৃদ্ধ বাঁচন চন্দ্র শুক্লাদাশ ও তাঁর স্ত্রী পলাশী বালা এখন চোখেমুখে শুধু অন্ধকারই দেখছেন। কারণ কয়েকদিন পর তাঁদের কন্যার বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পাত্রের সঙ্গে মেয়ের আশীর্বাদও (এনগেজমেন্ট) সম্পন্ন হয়ে গেছে। তাই বিয়েতে খরচ বাবদ আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে বাড়িতেই রেখেছিলেন নগদ তিন লাখ ২০ হাজার টাকা। সেই সাথে তিন ভরি স্বর্ণালঙ্কার, আসবাবপত্রও থরে থরে সাজানো ছিল বাড়িতে। কিন্তু মুহূর্তের অগ্নিকাণ্ডের নির্মমতায় সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

কন্যাদায়গ্রস্ত দম্পতি (বাঁচনপলাশী) পুড়ে যাওয়া টাকা অবশিষ্টাংশ দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, আমরা দিনে এনে দিনে খাই। মেয়েকে বিয়ে দেবো বলে স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা যোগাড় করেছিলাম। তিন ভরি স্বর্ণও কেনা হয়েছিল। আসবাবপত্রও আনা হয়েছিল বিয়েতে উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য। এখন তো কিছুই নেই। আমাদের মেয়ের বিয়ে কী করে দেবো।

অন্য পরিবারগুলোর মতো খোলা আকাশের নীচে বসবাস করা বাঁচন চন্দ্র শুক্লাদাশ দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সহযোগিতা চাই। তিনিই একমাত্র আমাদের ছায়া। যদি নির্দিষ্ট তারিখে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে না পারি তাহলে কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে পারবো না।

ক্ষতিগ্রস্ত মিটন চন্দ্র শুক্লাদাশ বলেন, আমি পাড়ার রাধামাধব হরিমন্দিরের অর্থ সম্পাদক। আমার বাড়িতেও ছিল নগদ ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। তন্মধ্যে মন্দির উন্নয়নের ৫৭ হাজার টাকাসহ সম্পূর্ণ টাকা, পুরো বসতবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

সর্বস্ব হারিয়ে হাতজোড় করে বৃদ্ধ মণিবালা শুক্লাদাশ স্থানীয় ভাষায় বলেন, আমার সবকিছুই ছিল। ছিল সুন্দর বাড়ি ও বাড়ি ভর্তি আসবাবপত্র। ছেলের ব্যবসার জন্য জমানো লাখ টাকা, কয়েক ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ সবকিছুই পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। এখন আমরা কোথায় যাবো। সরকার যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে আর মাথা গোঁজার ঠাইও হবে না আমাদের।

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ধূপি পাড়া ও মুসলিম পাড়ার প্রতিটি পরিবারের চিত্র একই। পরিবারগুলোর সদস্যরা অচেনা কোনো লোক দেখলেই তার কাছে ছুটছেন সাহায্য পেতে।

ধূপিপাড়া লাগোয়া ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ হোছন ও আবুল ফজল বলেন, পুরো পাড়ার সবাই তখন ঈদের নামাজ পড়া নিয়ে ব্যস্ত। কারণ ঠিকসময়ে মসজিদে যেতে না পারলে ঈদের নামাজ আদায় হবে না। তার ওপর কালবৈশাখীর দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তাই যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে আশঙ্কায় দ্রুত নামাজ আদায় করে বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল সবার মাঝে। কিন্তু সেই মুহূর্তে একটি বাড়ির চুলোর আগুন থেকে পুরো পাড়ার ৩২টি বাড়ি আগুনে ভষ্মিভূত হয়ে যায়। এ সময় গুরুত্বপূর্ণ দলিলদস্তাবেজসহ আমাদের সবার সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে না আসলে আশপাশের অসংখ্য বসতবাড়িও পুড়ে যেত।

কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. মক্কী ইকবাল হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতায় পরিবারগুলো একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাই এই মুহূর্তে সরকারের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। এজন্য পরিষদের পক্ষ থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা নিরূপন করে উপজেলা প্রশাসনের কাছে দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান দৈনিক আজাদীকে বলেন, আগুনে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর পাশে উপজেলা প্রশাসন সর্বদা রয়েছে। পরিদর্শনের সময় প্রাথমিকভাবে পরিবারগুলোকে নগদ ৩ হাজার টাকা এবং শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়। পরদিন প্রত্যেক পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক বান্ডিল করে ঢেউটিন দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

কক্সবাজার১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, কৈয়ারবিলে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ৩২ পরিবার যাতে আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে সেজন্য যথাযথ সহায়তা দেওয়া হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদনও করা হয়েছে ইতোমধ্যে। প্রাথমিকভাবে তাদের বাড়ি নির্মাণের জন্য ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে দুই বান্ডিল করে ঢেউটিন, প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী, নগদ টাকা প্রদান করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেঘ-পাহাড়ের মিতালি অভিভূত পর্যটক
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার সৈকতে গোসল করতে নেমে কিশোরের মৃত্যু