দিনদিন সমাজে ক্রমেই বেড়ে চলেছে নিঃসঙ্গ পিতা–মাতার সংখ্যা। এটি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিশেষ করে শিক্ষিত পরিবারে । কোনো দিনমজুর কিংবা দরিদ্র পরিবারে এটি তেমন একটা লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। ফলে বিষয়টি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলতঃ একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার পর এখন অনেক পরিবারে পিতা–মাতাদের এধরনের করুণ অবস্থার বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন অমানবিক এবং অবিবেচনামূলক কার্যকলাপ থেকে কীভাবে এসব মানুষদের বিরত রাখা কিংবা বের করে এনে সমাজকে সুন্দর রাখা যায় এ বিষয়ে সবাইকে চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমাদের সবার মনে রাখতে হবে যে, পিতা– মাতা আমাদের সবচেয়ে আপনজন এবং শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার মানুষ। এরা যদি আমাদের এ পৃথিবীতে না আনতো তাহলে আমরা আজ এ সুন্দর পৃথিবী দেখতাম না। তাই আমাদের জীবনে সর্বাগ্রে পিতা–মাতার স্থান। তাই এদের প্রতি আমাদের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমাদের যা আছে তা দিয়েই পিতা–মাতাকে খুশি রাখতে হবে। এরা যেমন শিশু এবং শৈশবে আমাদের খেলার সাথী ছিলো। আমাদেরকে আকঁড়ে রেখেছিলো পরম মমতায়। তাদের শেষ বয়সে এসে আমাদেরকে তাদের খেলার সাথী হতে হবে। তাদেরকেও আমাদের আকঁড়ে রাখতে হবে। কারণ সারা জীবন সন্তানদের পেছনে সময় দিয়ে, আদর ভালোবাসা, মায়ামমতা দিয়ে যে পিতা–মাতা সন্তানদের বড় করেছে সেই পিতা–মাতা যদি কোনো সন্তানের চোখের সামনে কষ্ট পায়, কিংবা একমুঠো খাবারের জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে তাহলে, একজন সন্তানের জন্য বিষয়টি হবে খুবই গর্হিত, অমানবিক এবং লজ্জাজনক কাজ। একজন সন্তান গরীব হতেই পারে, তার বেশি অর্থ প্রাচুর্য্য না থাকতে পারে, তার অর্থ এই নয় যে, সে তার পিতা–মাতাকে খাওয়াতে পারবে না। একজন সন্তানের যা কিছু আছে তাই নিয়েই সব পিতা–মাতা সবসময় খুশি থাকে। তাই সন্তানদের উচিত তাদের পিতা–মাতার প্রতি লক্ষ্য রাখা। প্রকৃতপক্ষে জীবনের স্বর্ণালী সময়গুলো ব্যয় করে এবং সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বির্সজন দিয়ে যে পিতা–মাতা তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করেন, জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দেখা যায় সেই সন্তানই পিতা–মাতাকে রেখে চলে গেছে ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশে উন্নত জীবনের খোঁজে। এদের অনেকেই আর দেশে ফিরে আসে না। পিতা–মাতার জন্য সামান্য অর্থ পাঠিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে মনে করে। দেশে বসবাস করলে এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ঢাকাকেই বেছে নেয় জীবন যাপনের জন্য। যার ফলে গাঁয়ের সাদাসিধে পিতা–মাতা ঢাকার মতো গিঞ্জি জায়গায় সহজে বসবাস করতে চায় না অগত্যা তাদের স্থান হয় গ্রামের নির্জন জায়গায়। যেখানে তাদের বসবাস করতে হয় একাকী এবং নিঃসঙ্গ অবস্থায়। অনেক সময় অবশ্য অর্থনৈতিক কারণে হোক কিংবা ব্যক্তিগত কারণে হোক অনেক সন্তানই তাদের পিতা–মাতাদের তাদের সঙ্গে রাখতে চায়না। যার ফলে বৃদ্ধ বয়সে পিতা–মাতা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। মুলতঃ দূর অতীতে এধরনের পিতা–মাতাকে নিঃসঙ্গ করে কোনো সন্তানই দূরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতো না। বরং পিতামাতাকে দেখে রাখার জন্য বাড়ির পাশের বাজারে কেউবা ব্যবসা করতো আবার কেউবা দূরে চাকরি করলেও পিতামাতাকে দেখার জন্য ছুটির দিন বাড়ি আসাটা কখনও ভুল করতো না। এখন পৃথিবী যতো উন্নত হচ্ছে এক একটা মানুষ যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। এরা উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু হৃদয়ে থাকছে না ভালোবাসা, মায়ামমতা। এরা পিতা–মাতাকে যে শেষ বয়সে পরম ভালোবাসা দিয়ে এবং আদর যত্ন করে দেখতে হয় সেটা বেমালুম ভুলে গেছে। প্রকৃতপক্ষে কোনো পিতা–মাতাই তাদের সন্তানের কাছে প্রতিদানের আশা করে তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে না। তবে তারা তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে তাদের সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ এবং একজন সুশিক্ষিত মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এক্ষেত্রে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত করেও কিন্তু দেখা গেছে এসমস্ত প্রতিষ্ঠিত এবং শিক্ষিতরাই তাদের পিতা–মাতাদের কষ্ট দেয় বেশি। আর এসমস্ত শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের পিতা–মাতা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দুমুঠো খাবারের জন্য সন্তানের দিকে চেয়ে থাকে। অনেক সময় এসব পিতা লজ্জা এবং ঘৃণায় এসব বিষয় মুখ ফুটে প্রকাশও করে না। তবুও এসমস্ত অমানবিক বিষয় সমাজের চোখ এড়িয়ে যায় না। অনেক সময় এসব বিষয় মিডিয়ার হেড লাইন হয় ফলে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। তবে জীবনের শেষ বয়সে এসে পিতা–মাতাদের সেবা যত্ন করে না কিংবা তাদের ভরণ পোষণ করে না এমন সন্তানের সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে কম হলেও ইদানীং এটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামনে এটি বাড়বে বৈ কমবে না, তাই এখন থেকেই এ বিষয়ে সমাজ বিজ্ঞানী এবং মনস্তাত্ত্বিকদের ভাবা উচিত। দূর অতীতে যে দেশটি পিতা–মাতা, চাচা–চাচী, খালা–খালু এবং পরিবারের অন্যান্য বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে একসাথে বসবাস করতে ভালোবাসতো এবং সবাই মিলে এদের ভরণ পোষণসহ অন্যান্য সব চাহিদা না চাইতে মেটাতো, আজ কেনো হঠাৎ করে আমাদের সমাজের এমন অবস্থা হলো? এমন অবস্থার জন্য দায়িইবা কারা ? একথা ঠিক যে, স্বাধীনতার আগে কিংবা স্বাধীনতাত্তোর এদেশে যে মূল্যবোধ ছিলো সে মূল্যবোধের অনেকটাই অবক্ষয় ঘটেছে। দেশ এগিয়ে গেলেও সামাজিক মূল্যবোধের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছে। এখন দেখা যায় অনেক সন্তানই তাদের পিতা–মাতার কথা শুনছে না। সে যেটা ঠিক মনে করছে সেটাই করছে আর সেখানেই সে ভুল করছে। পিতা–মাতার কথা না শোনে অনেক সন্তানই নানাবিধ সমাজবিরোধী কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে। অনেকেই আবার মাদক দ্রব্য সেবন করে বিপথে চলে যাচ্ছে। এসব সন্তান সুপথে ফেরাতে ফেরাতে অনেক সময় পিতা–মাতাদের অনেক শ্রম এবং অর্থ বিসর্জন দিতে হয়। তাছাড়া সন্তানদের লেখা পড়া, পরিবার পরিজনদের প্রাত্যাহিক খরচ এসব বিষয় মেটাতে মেটাতেই অনেক পিতা–মাতা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েন। সেই সন্তানই যখন জীবনের শেষ বয়সে এসে তাদের পাশে দাঁড়ায় না তখন পিতা–মাতা খুবই কষ্ট পায় এবং এ বিষয়ে কাউকে বলতেও লজ্জাবোধ করে কারণ এরা তো তাদেরই সন্তান। তাই আসুন শিক্ষিত হয়ে অবিবেচক এবং অমানুষের মতো পিতা–মাতাদের প্রতি আচরণ না করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে শিখি। তাদের শেষ জীবনে সুস্থ এবং সুন্দরভাবে কাটানোর জন্য বাড়িতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করি যেখানে তারা হাসিখুশিতে জীবন অতিবাহিত করতে পারে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।