নিঃসঙ্গতা বনাম আত্মহত্যা

মৃন্ময়ী মৃম | সোমবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আত্মহত্যা কেন করবেন আপনি? এত বড় পৃথিবীর কোলে আপনার কোথাও ঠাঁই নেই, কিছু করার নেই, দুজন বন্ধুও নেই এটা অসম্ভব এবং অবিশ্বাস্য। নিজের ভালো থাকাটা কখনো পুরোপুরি অন্যের উপর ছেড়ে দিয়ে নির্ভরশীল হবেন না কখনো। মানুষকে বিশ্বাস করবেন। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস করবেন না। কাউকে অন্ধ বিশ্বাস করা চরম বোকামি। কারণ মানুষ পরিবেশ,পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে বদলে নেয়। আজ যে নিকট, যাকে বন্ধু ভাবছেন আগামীতে সে হয়ে যেতে পারে যোজন যোজন দূরের মানুষ। এই বাস্তবতা গ্রহণ করার মত মানসিক দৃঢ়তা রাখবেন। কারও কাছে কখনো বেশি প্রত্যাশা রাখবেন না। যত কম প্রত্যাশা তত কম কষ্ট পাবেন। জীবন কখনো একভাবে যায় না। জোয়ার-ভাটার মত জীবনের গতি। তাই কোন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করার কথা কখনোই কেউ ভাববেন না। কোন অবস্থাতেই কেউ জীবনের অবসান করাটা সমাধান বলে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কাপুরুষ প্রমাণ করবেন না নিজেকে। ঘাত-প্রতিঘাতে জীবন যদি থমকে দাঁড়ায় চলতে চলতে আপনিও একটু জিরিয়ে নিন। দম ফেলুন। পুনর্বার চলার প্রস্তুতি নিন। এই সময়টুকুতে নিজেকে প্রচণ্ড ভালোবাসতে শুরু করেন। নিজেকে নিজেই উদার ভাবে গ্রহণ করুন। কী কী ভালো গুণ আছে আপনার মাঝে তা ভাবতে থাকুন আর সেজন্য নিজেকে বাহবা দিন। তারপর যা খারাপ গুণ আছে আপনার মাঝে সেগুলো পরিবর্তন করবেন বলে মন স্থির করুন। নিজেকে যদি অপাংক্তেয় মনে হয় কখনো তখন কার কার জীবনে কখনো আপনার জন্য সহযোগিতা পেয়েছে, সঙ্গ পেয়েছে,বিপদে আপনাকে কাছে পেয়েছে সেসব দিন স্মরণ করুন। স্মরণ করে ভাবতে থাকুন কখনো কারও না কারও জীবনে আপনার একসময় প্রয়োজন ছিল। তেমনি যতদিন বাঁচবেন কারো না কারো কোনো প্রয়োজনে অবশ্যই আপনি এগিয়ে যেতে পারবেন। মানুষের জীবন শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়। যারা ভাবে এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে শুধুমাত্র নিজের আরাম-আয়েশ, সুখ-সম্পদ, প্রাচুর্য ভোগ-বিলাস, যশ-খ্যাতির জন্য তাদের মত মস্ত বড় বোকা আর হয় না। তাদের দিকে কখনো তাকাবেন না একমাত্র তারা-ই সুখী ও সফল ভেবে।তাহলে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে সক্ষম হবেন না কখনো। বরং তারা অসুস্থ মানসিকতা এবং অপূর্ণ জীবনের অধিকারী সেটাই ভাবতে শিখুন।
ব্যস্ত নাগরিক জীবনে মানুষ আর আগের মতো সহজেই মেলামেশা করতে পারে না। যাদের ব্যস্ততা কম তারা তাই নিঃসঙ্গ ও একাকীত্বে ভোগেন। তার থেকে পরিত্রাণের উপায় কিন্তু বহুবিধ। আপনার নিজেকে তা খুঁজে নিতে হবে কারো উপর নিভর্র না করে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান। কাজেই প্রথমেই প্রকৃতির সাথে মিশে যান। কীভাবে ভাবছেন? ভোরে উঠুন। স্রষ্টার প্রার্থনার জন্য তৈরি হোন।পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ্থ পড়ুন। যদি একা চলাফেরার ক্ষমতা থাকে, সুস্থ শরীরের অধিকারী হোন তবে প্রার্থনা সেরেই হাঁটতে বেরিয়ে যান। বেশি দূরে যেতে না পারলে বাড়ির আশপাশে কিংবা ছাদে হাঁটুন। বাগান থাকলে অবলোকন করুন, পরিচর্যা করুন। সূর্যোদয় দেখুন। কয়েকটা ছবি তুলুন দৃশ্যের। গুনগুন করে আপন মনে গান গাইতে থাকুন, কবিতা বলতে থাকুন। আপনার দুই ঘন্টা অনায়াসে কেটে গেল ভোর থেকে এভাবে।
এবার বাসায় ফিরে কয়েকটি বিস্কুট বা মুড়ি দিয়ে চা/কফি খান। খেতে খেতে পেপার পড়ুন। টিভি দেখুন। ফেইসবুকে/মেসেঞ্জারে চোখ বুলিয়ে নিন। এরপর সকালের জলখাবার তৈরি করে খেয়ে নিন। খাওয়া শেষ হলে হালকা কোন মিউজিক চালিয়ে পছন্দের বই পড়ুন। লেখার অভ্যাস থাকলে লিখুন। এবার ঘড়ির দিকে তাকান। আপনি যদি একা হোন তবে এখন আপনার বাজির করা, কাপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা,ভাঁজ করা ঘর গুছানো, পরিষ্কার করা,এবং রান্না করার সময় হয়ে গেল। এসব কাজ সেরে স্নান করে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নিন। তারপর বিশ্রাম করুন যেভাবে মন চায়। আমি হয় গান শুনি নয়তো নাটক/ম্যুভি/ রান্না বা যেকোন সৃজনশীল পোগ্রামের ভিডিও দেখি। আপনিও তা করতে পারেন। বিকেল হতেই আবার প্রকৃতির সাথে মিশে যান। বাইরে বা ছাদে মুক্ত বাতাসে ঘোরাঘুরি করেন, সূর্যাস্ত উপভোগ করেন। সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে ফোনে /মেসেঞ্জারে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন তাদের সাথে কুশল বিনিময় করুন। টিভি দেখুন, গান শুনুন, কবিতা, গল্প,উপন্যাস বা যে কোনো পছন্দের বই পড়ুন। রাত ৯-১০ টার মধ্যে রাতের আহার সেরে গুড নাইট বলে শুয়ে পড়ুন। এই তো আপনার সময় পার হয়ে যাবে এভাবেই।
একগেঁয়ে লাগতে পারে এমন করে সবসময় তাই না? মাঝে মাঝে যে কোন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে, সৃজনশীল সাহিত্যিক যে কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন। মঞ্চ নাটক দেখতে যান। সময় নিয়ে চলে যান দূরে কোথাও কিছুদিনের জন্য। গ্রামের বাড়িতে বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে কাটিয়ে আসুন কিছুদিন। নদী,সমুদ্র, পাহাড় আছে এমন স্থানে ঘুরে আসুন। সৃজনশীল কাজের সাথে জড়িত হোন। সারা পৃথিবীতেই প্রচুর প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে আপনি স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করার সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশেও আছে তেমন অনেক প্রতিষ্ঠান। সেসব প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত হয়ে ঈযধৎরঃু ড়িৎশ করুন। কোনো কিছু নিয়ে নেগেটিভ ভাবনা পরিত্যাগ করুন। অতীতের সুন্দর সময় গুলো নিয়ে স্মৃতিচারণ করুন। যা আপনাকে বেদনা দেয়,হতাশ করে সেসব অতীত ভাবনায় আনবেন না পারতপক্ষে।
কে বলে মানুষ নিঃসঙ্গ, একা হলে জীবন থেমে যায়? আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টিয়ে সুদূরে প্রসারিত করতে হবে যদি নিঃসঙ্গ হতে না চান। দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই মানুষ বহু মানুষের সাথে প্রতিদিন চলেও কিন্তু নিঃসঙ্গ হয়। কাজেই নিঃসঙ্গতাকে জয় করুন দৃষ্টি সুদূরে মেলে ধরে। একাকীত্ব ভরিয়ে তুলুন নিজের ভালো লাগার কাজগুলো বেছে নিয়ে। রিমোট আপনার হাতে। আপনি নিজের মনের দরজা খুলুন, আলো-বাতাস ঢুকে ফুলে ফুলে মনবাগান ভরে উঠবে। তখন মনে হবে আপনি একজন আনন্দের ফেরীওয়ালা। আত্মহত্যা করার কথা ভুলেও মনে হবে না। উপরন্তু আফসোস করবেন এত বৈচিত্র্যময় মানব জীবন এত ছোট কেন! কেন কাছিমের মত তিনশ বছর বাঁচা যায় না। সকলের জন্য অজস্র শুভ কামনা আর অঢেল ভালোবাসা। সবাই আনন্দ কুড়িয়ে হাসুন। জীবন সুন্দর। জীবন প্রেমময়। বিষাদে পথ হারাবেন না বন্ধুরা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধধার্মিক সেজো না, ধার্মিক হও!
পরবর্তী নিবন্ধউপাসনালয়ে সামাজিক প্রকল্প : তেভাগা মডেল প্রস্তাবনা